অডিও শিল্পে যৌথ প্রযোজনা গানের জন্য অশনিসংকেত

লেখক: সাব এডিটর
প্রকাশ: ৭ years ago

চলচ্চিত্রে যৌথ প্রযোজনা অনেক আগেই ছিল। আশির দশকেও কলকাতার সঙ্গে যৌথভাবে অর্থলগ্নি করে বেশ কিছু ঢাকাই চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এ ধারা এখনও বিদ্যমান। তবে বর্তমানে ঢাকাই চলচ্চিত্রে যৌথ প্রযোজনা নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে। তাই চলচ্চিত্রকর্মীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে নীতিমালা তৈরি হয়েছে। এবার গানেও শুরু হয়েছে যৌথ প্রযোজনা। বিষয়টি সঙ্গীতাঙ্গনের জন্য হুমকি বলে মনে করছেন অনেকে।

আকাশ সেন বাংলাদেশের নাকি কলকাতার। সেটা হয়তো তিনি নিজেও ভুলে গেছেন। ২০১২ সালে ‘মোস্ট ওয়েলকাম’ ছবিতে কৈলাশ খেরের গাওয়া ‘কে কাহার’ দিয়ে শুরু। এরপর ‘নিঃস্বার্থ ভালোবাসা’য় করেন ‘ঢাকার পোলা’, ‘হোয়াট ইজ লাভ’ এবং ‘সাজনা ভালোবাসা ভোলা যায় না’ গানগুলো। ‘স্বপ্ন যে তুই’ ছবির আলোচিত গান ‘তোর চোখেতে চেয়ে’সহ তিনটি গান তার করা। ‘মোস্ট ওয়েলকাম-টু’ ছবিতেও সমানসংখ্যক গান। এরপর ‘চিকেন তন্দুরি’। কলকাতা-বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনার ‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’ ছবিতে ‘বাংলাদেশের মেয়ে’ গানটিও তার করা। ‘রোমিও বনাম জুলিয়েট’, ‘অগ্নি-২’, ‘অঙ্গার’, ‘মেন্টাল’, ‘পোড়ামন-২’ ছবিতেও রয়েছে তার গান। জাজের প্রায় প্রতি ছবিতেই রয়েছে তার গান। ‘আমি তোমার হতে চাই’ শিরোনামে বাংলাদেশের সিনেমার গানে কণ্ঠ দিয়েছেন বলিউডের শিল্পী অ্যাশ কিং। ‘টুকরো প্রেমের গল্প’ শিরোনামের একটি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন আসিফ আকবর ও কলকাতার মোনালী ঠাকুর। ‘আমি নেতা হবো’ ছবির ‘চুম্মা’ গান দিয়ে বেশ ভালোই সাড়া ফেলেছেন কলকাতার শিল্পী জেমি ইয়াসমিন। ‘চোরাবালি’ ছবিতে গেয়েছিলেন অনুপম রায়। ‘অগ্নি’ ছবিতে স্যাভির সুরে নেহা কাক্কর গেয়েছিলেন ‘ম্যাজিক মামনি’। ‘রক্ত’ ছবিতে গেয়েছিলেন কনিকা কাপুর। এ ছাড়াও শানসহ বেশ কয়েকজন এ সময়ের ভারতীয় শিল্পী বাংলাদেশের বহু ছবিতে কণ্ঠ দিয়েছেন।

শুধু চলচ্চিত্রে নয়, অ্যালবামের গানেও ঢাকা ও কলকাতার শিল্পীদের যৌথ প্রয়াস দীর্ঘদিনের। এ শিল্পতে যৌথ প্রযোজনায় মিউজিক ভিডিও নির্মাণের বিষয়টি একেবারেই নতুন। গেল বছর যৌথ প্রযোজনায় একটি মিউজিক ভিডিও নির্মাণ করেছেন সঙ্গীতশিল্পী কণা। ‘ইচ্ছেগুলো’ শিরোনামের গানটি ইউটিউবে প্রকাশ পেয়েছে। গানে কণ্ঠ দিয়েছেন কণা ও ভারতের আকাশ সেন। গানের মডেলও ছিলেন দু’দেশের দু’জন। একজন মুম্বাইয়ের নতুন মুখ আজহার সাইনি ও বাংলাদেশের মডেল-অভিনেত্রী তাসনুভা তিশা। কণা ও আকাশ সেনের যৌথ প্রযোজনায় রয়েছে ‘বৈশাখেরই বিকেল বেলায়’, ‘রেশমি চুড়ি’, ‘তুই আমার মন’সহ আরও কয়েকটি গান। শুধু চলচ্চিত্র কিংবা অ্যালবামই নয়। স্টেজ প্রোগ্রামেও রয়েছে ভারতীয় শিল্পীদের সরব পদচারণা। নানাভাবে বিভিন্ন আয়োজনে ভারতীয় শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন দেশীয় আয়োজকরা। বাংলাদেশে কথিত চুক্তিপত্র করে প্রতিবছর আয়োজন করা হচ্ছে বিদেশি শিল্পীদের কনসার্ট।

অন্য দিকে, বাংলাদেশি ছবিতে কলকাতার শিল্পীরা গান গাইলেও কলকাতার ছবিতে বাংলাদেশি শিল্পীদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। কলকাতার শিল্পীদের দিয়ে দেশীয় চলচ্চিত্রে গান করানোর গল্প পুরনো। একটা সময় যৌথ প্রযোজনার বাইরেও ভারতের অনেক শিল্পী বাংলাদেশি ছবির গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। যদিও তা ছিল হাতেগোনা। বর্তমানে বড় কোনো বাজেটের বাংলাদেশি সিনেমা মানে বিদেশি শিল্পী দিয়ে গান করানো। ‘ঢাকা অ্যাটাক’-এ গেয়েছিলেন বলিউডের জনপ্রিয় শিল্পী অরিজিৎ সিং। ‘টুপটাপ’ শিরোনামের সে গানের সুর ও সঙ্গীত করেছেন কলকাতার অরিন্দম। ‘আয়নাবাজি’ সিনেমায় গেয়েছেন কলকাতার অন্বেষা।

প্রবাদ আছে, ‘শিল্প-সংস্কৃতির দেশ জাতি নেই’। কিন্তু যখন যৌথ প্রযোজনা দেশের শিল্প-সংস্কৃতির জন্য ক্ষতিকর হয়, তখন কিছু বলতেই হয়। যৌথ প্রযোজনা নিয়ে সমস্যার অন্ত নেই। আবার নীতিমালা মেনে যৌথ প্রযোজনা করতে কোনো বাধা নেই। তথাপি যৌথ প্রযোজনা নিয়ে চর্চা এবং প্রতিহিংসা তথা দ্বন্দ্ব চলছে নিয়ম মাফিক। সিনেমার পর গানেও কলকাতার সংস্কৃতি বাংলাদেশে আষ্টেপৃষ্ঠে মিশে যাচ্ছে। বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে হরহামেশাই গান গাইছেন কলকাতার অনেক শিল্পী। নুসরাত ফারিয়া কলকাতা গিয়ে গানের ভিডিও নির্মাণ করেছেন। সেখানে বাংলাদেশি গীতিকার দিয়ে কলকাতার ভাষাতেই গান রচনা করেন। যদিও গানটি শ্রোতারা প্রত্যাখ্যান করেছে। লাইকের চেয়ে ডিজলাইক অনেক বেশি হয়েছে। অনুপম রায় মাসদুয়েক আগে নিজের কথা-সুর-সঙ্গীতে প্রকাশ করেন ‘বাংলাদেশের মেয়ে’ নামের একটি গানের ভিডিও। গানটিতে তার সঙ্গে মডেল হয়েছেন বাংলাদেশি নাবিলা। এ গানটিও খুব বেশি সুবিধা করতে পারেনি।

বর্তমানে যৌথ উদ্যোগে মিউজিক ভিডিও নির্মাণ বা দেশি ছবিতে বিদেশি শিল্পীদের গান হুমকি বলেই মনে করেন সঙ্গীতবোদ্ধারা। এটাকে বাংলাদেশি গানের জন্য একটা অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ। আবার কেউ কেউ জানিয়েছেন লজ্জা ও ক্ষোভের কথা। আবার কেউ কেউ বিষয়টিকে সাধুবাদও জানিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীতশিল্পী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘যার মেধা আছে সেই কাজ করবে। বিদেশি কেউ কাজ করছে, কিংবা যৌথ প্রযোজনায় কাজ হচ্ছে, এটা কোনো বিষয়ই নয়। এসব ভয়ে থাকেন মেধাহীনরা। যারা ইন্সট্র–মেন্ট ব্যবহার করে শিল্পী হয়েছেন, কিংবা অন্যের কাঁধে ভর করে সঙ্গীত পরিচালনা করেন, তারাই শঙ্কিত। প্রকৃত শিল্পীরা কখনই এসব নিয়ে তোয়াক্কা করার কথা নয়। তবে হ্যাঁ, যারা যৌথ প্রযোজনায় কাজ করছেন, দেশের স্বার্থ যাতে রক্ষা হয় সে বিষয়টি অবশ্যই তাদের খেয়াল রাখতে হবে। এতে কোনো দ্বিমত নেই।’

সৈয়দ আবদুল হাদী, সঙ্গীতশিল্পী:

যৌথ প্রযোজনায় গান করার দুটি দিক আমি দেখি। এক হচ্ছে, নিচু মার্কেটিং। দুই দেশের মানুষ গান করছে, এ জন্য কোনো চমক দেখানোর জন্য হয়তো এটা করা হয়। আর দুই হচ্ছে, এটা দেশীয় শিল্পী কলাকুশলীদের দুর্বলতা। নিজেদের প্রতি নিজেদের বিশ্বাস না থাকার কারণে হয়তো এটা করেন তারা। নিজেরা ভালো গান করলে দর্শক শ্রোতারা এটা নেবেন এ কথা তারা ভুলে যান।

আলাউদ্দিন আলী, গীতিকার ও সুরকার:

‘বাংলাদেশে ছবির গান থেকে শুরু করে এখন যেসব গান হচ্ছে, তার মধ্যে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখার মতো তেমন গান হচ্ছে না। এত কিছুর পর আবার যদি সেই সঙ্গে যোগ হয় বিদেশি শিল্পীর গান, সেখানে দেশের সঙ্গীতের ওপর অবশ্যই এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এসব বিষয় নিয়ে অনেক প্রতিবাদ করেছি। যেভাবে চলছে চলুক। ভালো কিছু হোক আমাদের সঙ্গীতাঙ্গনে এটাই কাম্য।

মাকসুদুল হক, সঙ্গীতশিল্পী:

১৮ কোটি মানুষের এই বাংলাদেশে শিল্পীর কোনো আকাল পড়েনি যে, ধার করে বিদেশ থেকে শিল্পী আনতে হবে। আমাদের দেশে তো শিল্পীর অভাব নেই, প্রত্যেকটা শিল্পী নিজেদের জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে। কেন আয়োজকরা বিদেশি শিল্পীদের আমন্ত্রণ করে তা আমার জানা নেই। এসব কিছু নিয়ে অবশ্যই সবার ভাবতে হবে এবং সেটা এখন থেকেই করতে হবে। নাহলে ক্ষতিগ্রস্ত নিজেরাই হব।

কুমার বিশ্বজিৎ, সঙ্গীতশিল্পী:

‘সব কিছুতেই তো এখন যৌথ প্রযোজনা চালু হয়ে গেছে, আমি বলব গানে কেন নয়? নীতিমালা মেনে কাজ করলে তো সমস্যা নেই। আমাদের সরকার যদি গানের যৌথ প্রযোজনা বিষয়ে নীতিমালা করে দেন তবে সমস্যা থাকবে না। অন্যদিকে আমাদের দেশের আয়োজকদের ভাবা উচিত আমাদের দেশ ছোট হলেও এ দেশ সংস্কৃতিসম্পন্ন। কোনো শিল্পীকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।

 

সংবাদটি শেয়ার করুন...