জাহিদ হাসান খান রনিঃ ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার দীপক কুমার ও আইজিআর মান্নানের ডানখ্যাত শরিফের কারিশমা! টাকা দিলেই হওয়া যায় কাজী! এই চক্রের হোতা কম্পিউটার অপারেটর শরীফুল ইসলাম আইজিআর খান মোঃ আবদুল মান্নান ও ঢাকা জেলা রেজিস্টার দীপক কুমার সরকারকে ম্যানেজ করে মোটা অংকের টাকার বিনিময় দলিল লেখকের লাইসেন্স, উমেদার পিয়ন, নকলনবীশ ও কাজী নিয়োগ দিয়ে থাকেন। আইজিআর মান্নান এর এই কাজে সে ছাড়াও আরো তিন কর্মচারী রয়েছে নিবন্ধন অফিসে। তারা হলেন, তৈয়াবুর রহমান, সাইফুল ইসলাম, মোয়াজ্জেম। আইজিআর মান্নানের বিভিন্ন অপকর্মের স্বাক্ষী তৈয়াবুর রহমান। বদলী, নিয়োগ সংক্রান্ত টাকা লেনদেন হয় সাইফুল ইসলাম মোয়াজ্জেম এর হাতে। জানা গেছে, খান মোঃ আবদুল মান্নান তাদেরকে খুব আগামীতে সাব রেজিষ্টার বানানোর শর্তে এই দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। অতিদ্রুতই তাদেরকে সাব রেজিস্টার বানাবেন বলেও নিবন্ধন অফিসে আলোচনা হয় অন্য কর্মচারীদের মাঝে। এদিকে শরিফের কার্শিমার কাছে হার মানে আইজিআর খান মোঃ আবদুল মান্নান ও জেলা রেজিস্টার দীপক কুমার। এক কথায় ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সে শরীফুলের কথাই শেষ কথা। ২০১৫ সালে নিবন্ধন পরিদপ্তরে শরীফুলের কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে নিয়োগ হয়। এরপর আর তার পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দুর্বারগতিতে দুর্নীতি করে এখন কোটি টাকার মালিক শরিফুল ইসলাম।
নাম তার মোহাম্মদ আব্দুস সালাম। তিনি উত্তরার একটি স্কুলের ৪র্থ শ্রেনী কর্মচারী। নিয়মিত এই স্কুলে হাজিরা দেন তিনি। এই চাকুরির পাশাপাশি তার খায়েশ উঠেছে কাজীগিরি করবেন। তার এমন খায়েশ পূর্ণও হয়েছে। সম্প্রতি নিয়মবর্হিভ‚তিভাবে তিনি কাজীগিরির অনুমোদনও নিয়েছেন। তবে তার পড়ালেখার সার্টিফিকেট নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ১৯৯৮ সালে প্রথম বিভাগে দাখিল পাশ করেন। এরপর তিনি আর পড়ালেখা করেননি। ঢাকার দক্ষিনখান এলাকায় একটি স্কুলে চাকুরি নেন ৪র্থ শ্রোনীর কর্মচারী হিসেবে। তারপর তিনি কাজী হতে নোয়াখালীর একটি মাদ্রাসা থেকে ২০১৭ সালে আলিম পাশ দেখিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান ৪৭ নং ওয়ার্ডের কাজী হিসেবে অনুমোদন নেন। তিনি ২০১৭ সালে যে মাদ্রাসা থেকে আলিম পরীক্ষা দিয়েছেন তা নোয়াখালী অঞ্চলে। আর যেদিন থেকে পরীক্ষা শুরু হয় তিনি সেই তারিখের আগ থেকেও পরীক্ষার দিনও তার কর্মস্থল উত্তরা হাই স্কুল এন্ড করেজে উপস্থিত ছিলেন। এবং তার হাজিরা খাতায় নিয়মিত হাজিরা দেওয়া আছে। তাহলে তিনি পরীক্ষা কেন্দ্র না গিয়ে কি পরীক্ষা দিলেন আর গিয়ে থাকলেও তার কর্মস্থলে কিভাবে তার হাজিরা দেয়া আছে? তাহলে আমরা কোন সঠিক ধরে নিবো তার কর্মস্থলে থাকা নাকি সেই পরীক্ষা কেন্দ্র গিয়ে পরীক্ষা দেয়া? এর রহস্য বের করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। একের পর এক রিট দাখিল ও হাইকোর্টে নিশেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তাকেই কাজী হিসেবে নিয়োগ দিলেন ঢাকা জেলা রেজিস্টার দীপক কুমার সরকার। সূত্র জানায়, নিবন্ধন মহাপরিদর্শক খান মোঃ আব্দুল মান্নানের ডান হাতখ্যাত প্রভাবশালী কম্পিউটার অপারেটর শরিফুল ইসলামের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকার বানিজ্য করেন ঢাকা সাব রেজিস্টার দীপক কুমার সরকার। তার মাধ্যমে টাকা নিয়ে ওয়ার্ডভিত্তিক একজন কাজী নিয়োগ দেওয়ার কথা থাকলেও টাকা নিয়ে প্রতিটি ওয়ার্ডে ৫-৮ জন কাজী নিয়োগ দেন দীপক কুমার সরকার। যদিও তিনি তা অস্বীকার করে দায় দিচ্ছেন মন্ত্রণালয়ের। তবে তার এ ধরনের ছলচাতুরী মন্ত্রণালয় সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে সবারই জানা। এ দিকে শুধু কাজী নয় নিবন্ধন মহা পরিদর্শক (আইজিআর) খান মোঃ আবদুল মান্নান দেশের প্রতিটি সাব রেজিস্টারে মোটা অংকের টাকার বিনিময় অস্থায়ী নকলনবিশ নিয়োগ দিয়েছেন। আইজিআর অফিসে অনেকেই কানাঘুষা করেন, নিবন্ধন মহা পরিদর্শক খান মোঃ আবদুল মান্নান সরকারের উচ্চ মহলের লোক দাবী করে বিভিন্ন অপকর্মে করে পার পেয়ে যাচ্ছেন। তাদের ভাষ্যমতে, মান্নান সাহেব নিজেকে প্রধানমন্ত্রী’র কাছে রোক দাবী করে আসছে। প্রধানমন্ত্রী নাকি মান্নানকে বিভিন্ন মিটিং দাওয়াত দিয়ে থাকেন। এমনকি সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী আমলার নাম ভাঙ্গিয়ে খান মোঃ আবদুল মান্নান সাব রেজিস্টারের কয়েক শ নকলনবিশ নিয়োগ দিয়েছেন জন প্রতি ৩-৪ লক্ষ টাকা করে ঘুষ নিয়ে। ঢাকা সাব রেজিস্টারের আতঙ্ক দুর্নীতিবাজ শরিফুল এর আগে খান মোঃ আবদুল মান্নানের নিবন্ধন অফিসে কর্মরত ছিল। সেখানে আইজিআর মান্নানের সকল ঘুষ লেনদেন শরিফুল ইসলামের হাত দিয়ে করতেন আইজিআর। এগুলো নিয়ে অভিযোগ উঠলে তাৎক্ষনিক শরিফুলকে অন্যত্রা বদলী করে দেয়া হয়। পরে শরিফুলকে ঢাকা রেজিস্টার অফিসে বদলী করে আনেন আইজিআর ও রেজিস্টার দীপক কুমার সরকার। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি শরিফুল ইসলামের। ঢাকা জেলা রেজিস্টার অফিসে এসেই নকলনবিশ, রেজিস্টার, কাজী সহ বিভিন্ন নিয়োগ ও বদলীতেও দুইহাতে টাকা কামিয়ে কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন শরিফ। আমাদের অনুসন্ধান অব্যাহত থাকবে আরো বিস্তারিত পরবর্তী সংখ্যায়। নিবন্ধন মহা পরিদর্শক খান মোঃ আবদুল মান্নান ও ঢাকা জেলা রেজিস্টার দীপক কুমার সরকারের বিভিন্ন সেক্টরে দুর্নীতি‘র চিত্র আগামী সংখ্যায় তুলে ধরা হবে।
কাজী নিয়োগে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ: রাজধানীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে নিকাহ রেজিস্টার বা কাজী নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে সিটি কর্পোরেশনের নবগঠিত ওয়ার্ডগুলোতে এই অনিয়ম বেশি হচ্ছে। নানরকম ছলচাতুরী ও অনিয়মের আশ্রয় নেয়া হচ্ছে এই নিয়োগে। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তাদের মতে কাজী নিয়োগের বিষয়টিই যন্ত্রনাদয়ক। ভুয়া কাজীদের একটি সিন্ডিকেট বিষয়টিকে বিতর্কিত করছে। শিগগিরই এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কাজী নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। সম্প্রতি এই বিতর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। যেসব শূন্য ওয়ার্ডে মামলা রিট আছে সেখানেও কাজী নিয়োগ দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নবগঠিত ৬১ ও ৬২ নং ওয়ার্ডে নিয়মবহির্ভ‚তভাবে প্যানেল কাজী নিয়োগ দেয়া হয়। পরবর্তীতে উক্ত ওয়ার্ডে মো. বনি আমিন নামে এক ব্যক্তি নিকাহ রেজিস্টার দাবি করে হাইকোর্ট (নং-১১৮৩১/১৮) রিট পিটিশন দায়ের করেন। উক্ত রিট পিটিশন হাইকোর্ট বিভাগের যৌথ বেঞ্চে দীর্ঘ শুনানিতে স্থগিতাদেশ প্রদান করেন। এই সমস্ত মামলার রায় গোপন রেখে প্যানেলে কাজী নিয়োগ দেয়া হয়। অভিযোগ আছে, এক্ষেত্রে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির কপিও যথাস্থানে সময়মতো বোর্ডে না টাঙিয়ে গোপন রেখে প্যানেল গঠন করা হয়। প্রভাবশালী এক কর্মকর্তার হয়ে জেলা রেজিস্টার কার্যালয়ের একজন কম্পিউটার অপারেটর এই ছলচাতুরীর সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে সূত্র জানায়। সূত্র জানায়, গত বছরে কাজী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির দরখাস্ত আহবান করে অসত উদ্দেশ্যে উক্ত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি গোপন রাখা হয়। গত বছর ৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় নোটিশ বোর্ডে ওই বিজ্ঞপ্তি দেখা যায়। যেখানে উল্লেখ ছিল ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সালে আবেদনের শেষ দিন। অর্থাৎ আবেদনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ওই বিজ্ঞপ্তি নোটিশ বোর্ডে টাঙানো হয়েছিল। একইভাবে ৬৯ ও ৫২ নং ওয়ার্ডেও কাজী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি গোপন করার অভিযোগ আছে। ঢাকা দক্ষিণখান ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের (বর্তমানে উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড) নিকাহ রেজিস্টার নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়মের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। ২০১৩ সালের ৩০ অক্টোবর এই অধিক্ষেত্রে নিয়োগ দেয়া হয় এইচএম গোলাম ছাদেককে। এ নিয়োগকে কেন্দ্র করে দুটি রিট এখন বিচারাধীন। আরেকটি নথিতে দেখা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নবগঠিত ৬৫ নম্বর ওয়ার্ডে (পূরাতন মাতুয়াইল ইউনিয়নের ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড) অস্থায়ী নিয়োগ পেয়ে দায়িত্ব পালন করছিলেন মোহাম্মদ নূর আলম। এ নিয়োগাদেশের পক্ষে স্ট্যাটাসকো রয়েছে হাইকোর্টের। তার পরও এ অধিক্ষেত্রে নতুন নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। বিষয়টি উল্লেখ করে গত বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি জেলা রেজিস্টারের দফতরকে চিঠি দেন মোহাম্মদ নূর আলম। কিন্তু তাতেও থামেননি নিয়োগ প্রক্রিয়া। এ বিষয়ে মোহাম্মদ নূর আলম বলেন, অনৈতিকভাবে পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে নানা ছলচাতুরির আশ্রয় নেয়া হচ্ছে। কর্তৃপক্ষকে আদালতের স্ট্যাটাসকোর বিষয়টি চিঠি দিয়ে অবহিত করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। কাজী নিয়োগের বিষয়ে জেলা রেজিস্টার দ্বীপক কুমার সরকার এ প্রতিবেদককে বলেন, এই কাজী নিয়োগের বিষয়টি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য যন্ত্রণাদয়ক। কাজী নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, কাজী নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যকে উপদেষ্টা করে জেলা রেজিস্টার, জেলা প্রশাসক কিংবা তার একজন প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট সিটি কর্পোরেশনের একজন প্রতিনিধির সমন্বয়ে ৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ ক্ষেত্রে জেলা রেজিস্ট্রার অফিসের কাজী নিয়োগের কোনো এখতিয়ার নেই। স¤পূর্ণ এখতিয়ার থাকে মন্ত্রণালয়ের। জেলা রেজিস্ট্রি অফিস এ ক্ষেত্রে শুধু দাফতরিক কাজগুলো গুছিয়ে দেয় মন্ত্রণালয়কে। তিনি আরো বলেন, রাজধানীতে ভুয়া কাজীদের একটি গ্রুপ আছে। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ রকম ২৩-২৪ জনের একটি তালিকা করা হয়েছে। খুব শিগগিরই এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ওইসব ভুয়া কাজীরাই কোন নিয়োগের বিপরীতে আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করে থাকেন। এ রকম ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ মোতাবেক কাজী নিয়োগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আরেক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, যেহেতু জেলা রেজিস্ট্রি অফিসের কাজী নিয়োগের কোনো ক্ষমতা নেই তাই নোটিশ বোর্ডে নির্ধারিত তারিখের পর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি টাঙিয়ে জেলা রেজিস্ট্রি অফিসের কোনো লাভ নেই। তিনি আরো বলেন, নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজী) নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পত্রিকায় প্রকাশ করার কোনো বিধান নেই। এটি জেলা রেজিস্ট্রার, ডিসি অফিস এবং সিটি কর্পোরেশনের নোটিশ বোর্ডে টাঙানো হয়।
ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির নানা অভিযোগ: ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার দীপক কুমার সরকারের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির নানা অভিযোগ উঠেছে। গত বছর প্রথম দফায় ১১ জন এবং দ্বিতীয় দফায় ৯ জন এবং তৃতীয় দফায় (চলতি বছর) ৭ জন সহ মোট ২৭ জন এক্সট্রা মোহরার কাছ থেকে পদোন্নতির জন্য জন প্রতি ৪ থেকে ৬ লক্ষ টাকা ঘুষ নিয়েছে বলে জানা গেছে। ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার দীপক কুমার সরকারকে নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক ১৬৫০১নং স্মারকে পিয়ন জাহাঙ্গীর আলমকে তেজগাঁও সাব রেজিস্ট্রি অফিস থেকে মোহাম্মদপুর বদলির নির্দেশ দেয়। কিন্তু দীপক কুমার সরকার মহাপরিদর্শকের নির্দেশ উপেক্ষা করে গত ১৪-২-২০১৯ ইং তারিখে ১৬৯৬(৯) নং স্মারকে জাহাঙ্গীর আলমকে দোহার অফিসে বদলির আদেশ দেয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এক্সট্রা মহড়া ও টিসি মোহড়ার পদোন্নতির তালিকা করার আগে পদোন্নতি বাছাই কমিটির নাম মাত্র মিটিং দেখিয়ে গত দুই বছরে ২৭ জনের পদোন্নতিতে প্রায় কোটি টাকা ঘুষ বাণিজ্য করেছেন তিনি। পদোন্নতি বাণিজ্য ছাড়াও পিয়ন বদলি ও ২১ সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে প্রতি মাসে ৬ লক্ষ টাকা মাসোহারা গ্রহণ করেন তিনি। এছাড়া সাব-রেজিস্ট্রি অফিস পরিদর্শনে গিয়ে প্রতি অফিস থেকে সর্বনিম্ন ১ লক্ষ টাকা করে পরিদশন ফ্রী গ্রহণ করেন। বিশেষ করে সম্প্রতি ঢাকা জেলার কাজী নিয়োগে তার বিরুদ্ধে ১০ থেকে ১২ লক্ষ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নতুন ওয়ার্ডগুলোতে শূন্য পদে কাজী নিয়োগের মামলার রিট থাকার পরেও তা তোয়াক্কা না করে মামলার ফাইল লুকিয়ে রেখে কাজী নিয়োগের কাজটি তিনি হাসিল করে নিয়েছেন। জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নবগঠিত ৬১ ও ৬২নং ওয়ার্ডের প্যানেলে কাজী নিয়োগ দেওয়া হয়। অথচ হাইকোর্ট বিভাগে ৭৩২৭/১৫ রিট পিটিশন রায় প্রদান করেন। পরবর্তীতে উক্ত ওয়ার্ডের মো: রনি আমিন নিকা রেজিস্টার দাবি করে মহামান্য হাইকোর্টে ১১৮৩১/১৮নং রিট পিটিশন দায়ের করেন। উক্ত রিট পিটিশন হাইকোর্ট বেঞ্চে যৌথ শুনানিতে স্থগিতাদেশ প্রদান করেন। এ সমস্ত মামলার রায় গোপন রেখে জেলা রেজিস্ট্রার ক¤িপউটার অপারেটর শরিফুল ইসলাম এর মাধ্যমে ঘুষ নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দিয়ে চাপ প্রয়োগ করে প্যানেলে কাজী নিয়োগ দেন। দীপক কুমার সরকার ৬০ টাকা মজুরি ভিত্তিক পিয়ন রানাকে ধানমন্ডি অফিস থেকে আশুলিয়া সাব রেজিস্ট্রি অফিসে বদলীর চার মাস পর ধানমন্ডি অফিসে আবারো ফিরিয়ে আনার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি টক অফ দ্য রেজিস্ট্রেশন বিভাগে প্রণীত হয়েছে। রেজিস্ট্রেশন বিভাগের মজুরিভিত্তিক পিয়ন বদলির এটাই প্রথম নজির। রানা মজুরিভিত্তিক পিয়ন বলে চাকরির ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না। এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার দীপক কুমার সরকার নিজেকে সাদু বলে দাবি করলেও অনিয়ম দুর্নীতি করে তিনি ভারতের কলকাতার শেলটেকে বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করেছেন। তিনি ঢাকার ২১ সাব রেজিস্ট্রি অফিস থেকে পরিদর্শনের নামে এবং প্রতিমাসে একটি সুনির্দিষ্ট মাসোহারা গ্রহণ করে থাকেন। এছাড়াও হেডক্লার্ক ও কম্পিউটার অপারেটরের মাধ্যমে সুকৌশলে ঘুষ বাণিজ্য করে থাকেন। অভিযোগের ব্যাপারে ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার দীপক কুমার সরকার বলেন, অভিযোগ একজনের বিরুদ্ধে উঠতেই পারে। আমার কাছ থেকে যারা সুবিধা নিতে পারছেন না তারাই আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার করছেন। কারণ সবকিছু ম্যানেজ করে চলতে পারি না। সবকিছু ম্যানেজ করতে পারলে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠত না।
হাইকোর্টও মানছেন না ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার!: ঢাকার জেলা রেজিস্ট্রার দীপক কুমার সরকার হাইকোর্টের নির্দেশনা মানছেন না মর্মে অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে, একের পর এক তিনি লঙ্ঘন করে চলেছেন হাইকোর্টের রুল, স্থগিতাদেশ, স্থিতি আদেশ ও নিষেধাজ্ঞা। বিচারাধীন বিষয়ের ওপর কার্যক্রম চালাচ্ছেন তিনি বেপরোয়াভাবে। একটি সিন্ডিকেটের হয়ে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে তিনি আদালত অবমাননার ঝুঁকি নিচ্ছেন। এক্ষেত্রে দিচ্ছেন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার দোহাই। রিটের আর্জিতে উল্লিখিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে রাজধানীর ডেমরার পাড়াডগাইর ৬৪ নম্বর ওয়ার্ডে মো. মাশকুর রহমান অস্থায়ী নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজী) হিসেবে নিয়োগ পান। ২০১৭ সালে এক রিট পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে (নং-১৫৬১১/২০১৭) হাইকোর্ট অস্থায়ী এ নিয়োগাদেশের ওপর স্ট্যাটাসকো দেন, যা এখনো বহাল আছে। এ আদেশটি গোপন রাখেন ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার। গত ১৭ জুলাই ওই ওয়ার্ডে নিকাহ রেজিস্ট্রার নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী এ বিজ্ঞপ্তি জেলা রেজিস্ট্রার অফিসের নোটিশ বোর্ডে ঝুলিয়ে দিতে হয়। অথচ বিজ্ঞপ্তিটি যাতে আগ্রহী প্রার্থীদের দৃষ্টিতে না পড়ে সেজন্য তিনি সেটি বোর্ডে ঝোলাননি। নিয়োগ প্রক্রিয়াকে বৈধতা দিতে তিনি আশ্রয় নেন আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকায় ঘুপচি বিজ্ঞাপনের। ফলে জেলা রেজিস্ট্রারের পছন্দসই প্রার্থী ছাড়া আর কেউ ওই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির খবর জানতে পারেননি। আরেক রেকর্ডে দেখা যায়, একই কান্ড তিনি করেছেন দক্ষিণখান ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের (বর্তমানে উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড) নিকাহ রেজিস্ট্রার নিয়োগের ক্ষেত্রেও। ২০১৩ সালের ৩০ অক্টোবর এই অধিক্ষেত্রে নিয়োগ দেওয়া হয় {(স্মারক নং-বিচার-৭/২ এন-৮২/২০১৩ (অংশ) ১৩৭২} এইচএম গোলাম ছাদেককে। এ নিয়োগকে কেন্দ্র করে দুটি রিট এখন বিচারাধীন (রিট নং-৫৭১/১৭ ও ২৪৬৩/১৭)। পৃথক দুই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের ডিভিশন বেঞ্চ ২০১৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী মাসে নিয়োগ কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেন। জারি করেন রুল। রুলটি এখন চ‚ড়ান্ত শুনানির অপেক্ষায়। মামলাটি বিচারাধীন থাকা অবস্থাতেই গত ২০ ফেব্রুয়ারী নিকাহ রেজিস্ট্রার নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি {স্মারক নং-১৯৫০ (৮)} দেন দীপক কুমার। এর ভিত্তিতে আগ্রহী প্রার্থীদের কাছ থেকে আবেদন নিয়ে নিয়োগের সুপারিশসহ গত ১৬ মে তিনজনের প্যানেলও পাঠিয়ে দেন (স্মারক নং-৫৩৮৬) তিনি আইন মন্ত্রণালয়ের বিচার শাখা-৭-এ। এই অধিক্ষেত্রে এখন নিয়োগের চেষ্টা চলছে। আরেকটি নথিতে দেখা যায়, ২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর রাজধানীর কদমতলীর শ্যামপুর ইউনিয়নের ৪, ৫ (অংশ) এবং ৭, ৮, ৯ ওয়ার্ডের নিকাহ রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ পান {স্মারক নং-১৩১২, বিচার-৭/২ এন-১৬০/৮০ (অংশ-১)} মো. জাকির হোসাইন। অধিক্ষেত্রটি এখন ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৫৯ নম্বর ওয়ার্ডসংশ্লিষ্ট। রিট (নং-১২৬/১৭) রয়েছে এ নিয়োগ নিয়েও। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ নিয়োগ প্রক্রিয়ার ওপর স্ট্যাটাসকো দেন। এ আদেশ অগ্রাহ্য করে দীপক কুমার সরকার নিয়োগ প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন। একইভাবে মো. ছানাউল হক নিকাহ রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ {স্মারক নং-১৩১১, বিচার-৭/২ এন-১৬০/৮০ (অংশ)} পান যাত্রাবাড়ী থানাধীন দনিয়া ইউনিয়নের ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে। অধিক্ষেত্রটি বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৬২ নম্বর ওয়ার্ডের অংশ। একটি রিট পিটিশনের (নং-১৫০৩০/১৭) পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের স্ট্যাটাসকো রয়েছে এ নিয়োগ প্রক্রিয়ার ওপরও। দীপক কুমার সরকার এটিও অগ্রাহ্য করে নিয়োগ প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নবগঠিত ৬৫ নম্বর ওয়ার্ডে (পূর্বতন মাতুয়াইল ইউনিয়নের ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড) অস্থায়ী নিয়োগ পেয়ে দায়িত্ব পালন করছিলেন মোহাম্মদ নূর আলম। এ নিয়োগাদেশের পক্ষে স্ট্যাটাসকো রয়েছে (রিট নং-১৪৮২১/২০১৬) হাইকোর্টের। তারপরও এ অধিক্ষেত্রে নতুন নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন দীপক কুমার। বিষয়টি উল্লেখ করে চলতি বছর ১১ ফেব্রুয়ারী জেলা রেজিস্ট্রারের দফতরকে চিঠি দেন মোহাম্মদ নূর আলম। তাতেও থামেননি জেলা রেজিস্ট্রার। এ বিষয়ে মোহাম্মদ নূর আলম বলেন, ঢাকার বর্তমান জেলা রেজিস্ট্রার হাইকোর্টও মানছেন না। মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে পছন্দসই ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে নানা চাতুর্যের আশ্রয় নিচ্ছেন তিনি। আদালতের স্ট্যাটাসকোর বিষয়টি তাকে চিঠি দিয়ে অবহিত করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। কারণ তিনি অর্থ আর আইন মন্ত্রণালয়ের বিচার শাখা-৭-এ ওঁৎ পেতে থাকা একটি সিন্ডিকেটের হাতে বন্দি। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার দীপক কুমার সরকার বলেন, কোনো অধিক্ষেত্রে নিকাহ রেজিস্ট্রার নিয়োগ নিয়ে রিট হতেই পারে। দেখার বিষয় হলো, নিয়োগের ওপর স্থগিতাদেশ আছে কি না। যে ওয়ার্ডগুলোর কথা উল্লেখ করলেন, সেগুলোর ওপর হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ থাকলে সেটি আইন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখাকে জানাতে হবে। আমাদের কাছে এমন কোনো তথ্য নেই। উচ্চ আদালতের আদেশের বিষয়ে আমরা সব সময়ই শ্রদ্ধাশীল। তাছাড়া নিকাহ রেজিস্ট্রার নিয়োগের কোনো একক ক্ষমতা আমার নেই। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশেই প্যানেল করা হয়েছে। অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ করা যেতেই পারে। তবে এটি সঠিক নয়। আপনি সরেজমিন এসে দেখে যেতে পারেন।