মো. জিয়াউর রহমান: প্রতি বছর সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কের জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সারা বিশ্বের সব দেশের নেতারা বৈঠকে বসেন এবং বিভিন্ন বৈশ্বিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। একই মঞ্চে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের নেতা ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একে অপরের সাথে সাক্ষাত হয় বলে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এই সভাকে ‘কূটনৈতিক স্পিড ডেটিং’ ইভেন্ট হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন অনেক কূটনীতিক।
এবারের সাধারণ পরিষদের সভায় প্রধান আলোচনা বিষয় থাকবে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যুটি। এর পাশাপাশি প্রাধান্য পাবে ইউক্রেন যুদ্ধও।
কিন্তু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে কেন এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা? জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের গুরুত্বই বা কী?
জাতিসংঘ ও সাধারণ পরিষদ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৫ সালে যখন জাতিসংঘ গঠন করা হয়, তখন এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভবিষ্যত প্রজন্মকে যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করা। সেসময় ৫১টি দেশ নিয়ে তৈরি হওয়া সংস্থাটির বর্তমান সদস্য দেশ ১৯৩টি। এর বাইরেও পোপের অধীনে থাকা রোমের অঞ্চল হোলি সি বা ভ্যাটিকান সিটি এবং ফিলিস্তিনও জাতিসংঘের অন্তর্ভূক্ত।
সহজভাবে বললে, জাতিসংঘের মূল লক্ষ্য পারস্পারিক সহায়তার মাধ্যমে সার্বিক উন্নয়ন ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা।
জাতিসংঘের অধীনে সারা বিশ্বে কয়েক হাজার উন্নয়ন প্রকল্প, ত্রাণ কার্যক্রম ও আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা পরিচালিত হয়।
পরিবেশ ও জলবায়ু থেকে শুরু করে, শিক্ষা, শিশু অধিকার, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সহ বিভিন্ন বিষয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তিও সম্পন্ন হয়ে থাকে জাতিসংঘের তত্বাবধানে।
জাতিসংঘের প্রধান শাখা ছয়টি। যার মধ্যে তিনটি শাখাকে মনে করা হয় সংস্থাটির কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অপরিহার্য।
এগুলো হল সাধারণ পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ ও সেক্রেটারিয়েট বা সচিবালয়।
নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য ১৫টি দেশ, যাদের মধ্যে স্থায়ী সদস্য দেশ ৫টি। বাকি দশটি দেশ দুই বছরের জন্য সদস্য পদ পায়।
আর সেক্রেটারিয়েটকে বিবেচনা করা হয় জাতিসংঘের প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্র হিসেবে। বিভিন্ন দেশের হাজারো কর্মী কাজ করেন নিউ ইয়র্ক, জেনিভা, নাইরোবি আর ভিয়েনায় অবস্থিত জাতিসংঘের কেন্দ্রীয় কার্যালয়গুলোতে।
এই শাখাগুলোর মধ্যে সাধারণ পরিষদের সভার মধ্য দিয়েই জাতিসংঘের অধিকাংশ কাজ শুরু হয়ে থাকে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এই সংস্থাটির একমাত্র শাখা যেখানে ১৯৩টি সদস্য দেশের সবাই প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পায়। প্রতিটি সদস্য দেশই এই সভায় বক্তব্য রাখার সুযোগ পায়।
এই সাধারণ পরিষদের সভায় প্রত্যেক দেশের নেতা অথবা দেশটির কোনো একজন প্রতিনিধি সাধারণত বক্তব্য দিয়ে থাকেন। এবং যেসব বিষয়ে ভোটাভুটি হয়ে থাকে সেখানে ভোট দেয়ার সুযোগ পেয়ে থাকে। আর সাধারণ পরিষদে প্রত্যেক সদস্যের ভোট সমান গুরুত্ব পেয়ে থাকে।
নিরাপত্তা পরিষদের সুপারিশ অনুযায়ী সাধারণ পরিষদ জাতিসংঘের মহাসচিব কে হবেন, তাও নির্ধারণ করে থাকে।
পাশাপাশি নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য কারা হবে এবং জাতিসংঘের বাজেট কেমন হবে, সেটিও নির্ধারণ করা হয় সাধারণ পরিষদে।
সাধারণ সভার বিতর্ক কীভাবে কাজ করে?
সাধারণত সাধারণ সভায় প্রথম বক্তব্য দেয় ব্রাজিলের নেতা, তারপর বক্তব্য রাখেন স্বাগতিক যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।
একসময় যখন সাধারণ পরিষদের সভায় কোনো দেশ শুরুর বক্তব্য রাখতে চাইতো না, তখন ব্রাজিল স্বপ্রণোদিত হয়ে শুরুতে বক্তব্য দেয়ার রেওয়াজ চালু করেছিল। সেই রীতি মেনেই এখনও ব্রাজিলই সভার সূচনা বক্তব্য দেয়।
জাতিসংঘের ছয়টি আনুষ্ঠানিক ভাষার – আরবি, চাইনিজ, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, রাশিয়ান, স্প্যানিশ - যে কোনো একটি ব্যবহার করে প্রত্যেক দেশের নেতা বা নেতার প্রতিনিধি বক্তব্য দিতে পারে।
প্রত্যেক সদস্যকে ১৫ মিনিটের মধ্যে বক্তব্য শেষ করতে বলা হলেও প্রতিনিয়তই এই নিয়ম ভাঙা হয়ে থাকে।
যেমন সাধারণ সভায় দীর্ঘতম ভাষণ দেয়ার রেকর্ড কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রোর। ১৯৬০ সালে তার বক্তব্যের দৈর্ঘ্য ছিল সাড়ে চার ঘণ্টা।
প্রত্যেক দেশের প্রতিনিধিরা দেশের নাম অনুযায়ী ইংরেজি অ্যালফাবেটিক অর্ডারে বসে থাকেন। তবে প্রথম আসনে কোন দেশ বসবে, তা নির্ধারণ করেন জাতিসংঘ মহাসচিব।