
দুর্নীতিতে বেপরোয়া জ্বালানি বিভাগের সচিব নাজিমউদ্দিন চৌধুরী। প্রধানমন্ত্রী তথা বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রী এবং মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী- কাউকেই তোয়াক্কা করছেন না এই সচিব। অনেক ক্ষেত্রে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর অনুমতি ছাড়াই নিজের ইচ্ছে মতো যা খুশি করে যাচ্ছেন তিনি। সচিবের এমন স্বেচ্ছাচারী নানান কর্মকা- ও অনিয়ম-দুর্নীতিতে বিব্রত মন্ত্রণালয়, এমনকি সরকারও। তথাকথিত বহুল বিতর্কিত দায়মুক্তি আইনের অন্তরালে বিশেষ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অর্থ ভাগ-বাটোয়ারা করা হচ্ছে। টেন্ডার বা দর যাচাইয়ের কোনও বালাই নেই। যাকে ইচ্ছে কাজ দেওয়া হচ্ছে। এভাবে সচিবের বেপরোয়া সিদ্ধান্তে জ্বালানি বিভাগে নানা কাজ বাস্তবায়ন ও অনুমোদন হওয়ায় এরই মধ্যে সরকার তথা জনগণের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এদিকে অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে জ্বালানি সচিব সম্প্রতি সুন্দরবনসহ সারা দেশে একটি বিতর্কিত কোম্পানিকে স্থাপনা তৈরির অনুমতি দিয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। যা নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক বিতর্ক দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, বড় অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে ওই কোম্পানিকে সারা দেশে ৩০০ অটো গ্যাস স্টেশন স্থাপনের অনুমতি দেন জ্বালানি সচিব। ওই সব গ্যাস স্টেশনে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে জাহাজে এলপি গ্যাস সরবরাহ করা হবে। সচিবের এ সিদ্ধান্তে সুন্দবনের পরিবেশ মারাত্মক দূষণঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা করছেন পরিবেশ ও বনমন্ত্রীসহ পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। সচিবের এমন স্বেচ্ছাচারী ও পরিবেশ ধ্বংসের সিদ্ধান্তে তাকে শাস্তির আওতায় আনার দাবি করেছে টিআইবি। তবে সব কিছুর পরও বহাল তবিয়তেই আছেন দুর্নীতিবাজ সচিব নাজিমউদ্দিন। এতে প্রতিমন্ত্রীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। ফলে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও।
‘দায়মুক্তি’র অন্তরালে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ‘দায়মুক্তি’ আইনের অন্তরালে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। ২০১০ সালে দায়মুক্তির ওই আইন পাশের পর ২০১২-তে শুরু হয় হরিলুট কা-। এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। এই দায়মুক্তি আইনকে কেন্দ্র করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতে একাধিক বিশেষ সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এরাই সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ম্যানেজ করে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। জ্বালানি সচিব পদে নাজিমউদ্দিন চৌধুরী নিয়োগ পাবার পর এই লুটপাট প্রবণতা আগের চেয়ে অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছিল।
জানা গেছে, দেশীয় রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে দায়মুক্তির সুযোগ নিয়ে রাশিয়ার প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রমের সঙ্গে শুরুতে বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্রের ১০টি উন্নয়ন কূপ খননের চুক্তি করে পেট্রোবাংলা। এতে অন্তত এক হাজার কোটি টাকা সরকারের ক্ষতি হয়েছে। একই কোম্পানির সঙ্গে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল) ৮টি চুক্তি করে। এর মধ্যে দুটি গ্যাস কম্প্রেসর এবং আশুগঞ্জ থেকে এলেঙ্গা, বাখরাবাদ থেকে সিদ্ধিরগঞ্জ এবং ভেড়ামারা থেকে খুলনা পর্যন্ত তিনটি গ্যাস ট্রান্সমিশন লাইন স্থাপনের কাজ রয়েছে। সর্বশেষ ২০১৬ সালের জুলাইয়ে বাপেক্সকে বাদ দিয়ে আরও দুটি গ্যাসক্ষেত্র, যথা- শাহবাজপুর (পূর্ব) ও ভোলা (উত্তর) খননে ১০৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা বেশি দরে বিতর্কিত ও দুর্নীতিবাজ বিদেশি কোম্পানি গ্যাজপ্রমকে কাজ দেয়া হয়। এতে সচিব নাজিমউদ্দিন চৌধুরী মূল ভূমিকা পালন করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সবমিলিয়ে অন্তত ১৮টি গ্যাসক্ষেত্র খননের দায়িত্ব দেয়া হয় গ্যাজপ্রমকে। এর মধ্যে কাজ শেষ করা ৯টি গ্যাসক্ষেত্র খননে অন্তত ১ হাজার ৬শ’ ৫৭ কোটি টাকা সরকারের কাছ থেকে নিয়েছে গ্যাজপ্রম। অথচ দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে দিয়ে খনন করালে খরচ হতো মাত্র ৭শ’ ২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৯টি কূপ থেকেই গ্রাজপ্রম বাড়তি টাকা নিয়েছে ৩শ’ কোটি টাকার বেশি। শুধু গ্যাজপ্রমই নয়। একইভাবে চীনা প্রতিষ্ঠান সিনোপ্যাকও বেশ কিছু গ্যাসক্ষেত্র খননের আড়ালে শত শত কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে নিয়ে গেছে।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আর জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর সভার সিদ্ধান্তকে জালিয়াতির মাধ্যমে বিকৃত করে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বেসরকারি খাতের দুটি ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্টকে ৬৬ শতাংশ কনডেনসেট বরাদ্দ দেয়া হয়। এছাড়া ১১টি কোম্পানিকে দেয়া হয় ৩৩ শতাংশ কনডেনসেট। এতে সরকারের কম আয় হয়েছে অন্তত ৫শ’ কোটি টাকা। এছাড়া দায়মুক্তি আইনের আওতায় কক্সবাজারের মহেশখালীতে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ভাসমান টার্মিনাল স্থাপনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এক্সট্রা অয়েল অ্যান্ড এক্সিলারেট এনার্জির সঙ্গে অনুস্বাক্ষর করেছে পেট্রোবাংলা। যা চলতি বছরের গত এপ্রিলে চালু হয়েছে। এখানেও কয়েকশ’ কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে।
সচিবের সিদ্ধান্তে ঝুঁকিতে সুন্দরবন
নিয়ম না মেনে সারা দেশে যানবাহনের জ্বালানির জন্য ৩০০ অটো গ্যাস স্টেশন স্থাপন এবং সেখানে এলপি গ্যাস সরবরাহে বিতর্কিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এনার্জিপ্যাককে অবৈধভাবে অনুমোদন দিয়েছেন জ্বালানি বিভাগের সচিব। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সুন্দরবনের আরও কাছে স্থাপিত এ প্রতিষ্ঠানটির স্থাপনা থেকে এই গ্যাস সরবরাহ করা হবে। এই স্থাপনায় এলপি গ্যাস আমদানির ফলে সুন্দরবনের ভেতরে জাহাজ চলাচল বেড়ে যাবে। এতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় বন সুন্দরবন আরও দূষণঝুঁকির মুখে পড়বে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিতর্কিত এনার্জিপ্যাককে অটো গ্যাস স্টেশন স্থাপন এবং সেখানে গ্যাস সরবরাহের অনুমোদনে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) আপত্তি ছিল। এমনকি এই অনুমোদনে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের স্বাক্ষরও নেওয়া হয়নি। বিধি না মেনে এককভাবে এ অনুমতি দিয়েছেন জ্বালানি বিভাগের সচিব নাজিমউদ্দিন চৌধুরী। প্রতিমন্ত্রীর স্বাক্ষর না নিয়ে নথি অনুমোদনের বিষয়ে মিডিয়ার সঙ্গে মুখ খুলতে নারাজ সচিব। বিতর্কিত কোম্পানি এনার্জিপ্যাক জি-গ্যাস নামে অবৈধভাবে বাজারে বোতলজাত এলপি গ্যাস বিক্রি করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির এলপি গ্যাসের স্থাপনাটি খুলনার সুন্দরবন সংলগ্ন দাকোপের চুনকুটিতে অবস্থিত। এলপি গ্যাস ছাড়াও এনার্জিপ্যাকের বিদ্যুৎ খাতে ব্যবসা রয়েছে। যদিও প্রতিষ্ঠানটির এ নিয়ে বৈধ কাগজপত্র নেই। এ কারণে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকান্ডে আপত্তিও আছে বিপিসির।
সূত্রমতে, তরল পেট্রোলিয়াম (এলপি) গ্যাস বাংলাদেশে মূলত বাসাবাড়ি বা হোটেল-রেস্তোরাঁয় রান্নার কাজে ব্যবহৃত হয়। অটো গ্যাস নামে পরিচিত এ জ্বালানি দিয়ে বর্তমানে যানবাহন চলছে। এর বাইরে বর্তমানে সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাস বা সিএনজি দিয়েও যানবাহন চলছে। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অনুমোদন সম্পর্কে এনার্জিপ্যাক ও জি-গ্যাসের পরিচালক রিজুয়ানুল কবির গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের অটো গ্যাসের অনুমতি যাতে দ্রুত হয়, সে কারণে জ্বালানি বিভাগের সচিব এভাবে ব্যবস্থা নিয়েছেন। এটি করা হয়েছে যাতে প্রকল্পটি দ্রুত করা যায়।’ তবে ঘুষ লেনদেনের কথা অস্বীকার করেন তিনি।
যেভাবে অনুমোদন পেল এনার্জিপ্যাক
অটো গ্যাস স্টেশন স্থাপন ও সরবরাহের জন্য আগ্রহী প্রতিষ্ঠানকে নিয়মানুযায়ী প্রথমে জ্বালানি বিভাগে আবেদন করতে হয়। সেখান থেকে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানটির প্রকল্প এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করার জন্য বিপিসি ও বিস্ফোরক পরিদফতরের সংশ্লিষ্টদের পাঠানো হয়। নিয়ম অনুযায়ী আবেদনকারী প্রতিষ্ঠান যেসব স্থানে অটো গ্যাস স্টেশন স্থাপন করতে চায়, সেই জমিরও মানচিত্র এবং জমির প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও বিপিসি এবং বিস্ফোরক পরিদফতরে জমা দিতে হয়। বিপিসি ও বিস্ফোরক পরিদফতর সরেজমিনে সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন জমা দেয় জ্বালানি বিভাগে। এর পর জ্বালানি বিভাগ বোতলজাত এলপি গ্যাসের স্থাপনা ও অটো গ্যাস স্থাপনের প্রাথমিক অনুমতি দিয়ে থাকে। আর তাতে সম্মতি থাকতে হয় সচিব ও প্রতিমন্ত্রীর। কিন্তু এনার্জিপ্যাককে সারা দেশে ৩০০ অটো গ্যাস স্টেশন স্থাপন এবং সেখানে গ্যাস সরবরাহের অনুমোদন দিতে গিয়ে জ্বালানি সচিব নিয়মের সব ধাপই ভেঙেছেন। বিপিসির আপত্তিকে উপেক্ষা করে, এমনকি জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর সই ছাড়াই এই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদকে অনুপস্থিত দেখিয়ে জ্বালানি বিভাগের সচিব নাজিমউদ্দিন চৌধুরী গত ১৪ জানুয়ারি এনার্জিপ্যাককে ৩০০ অটো গ্যাস স্থাপনের অনুমতি দেন। প্রতিমন্ত্রী দেশে ফেরার পর তাকে অবগত করা হবে বলে অনুমোদনের নথিতে উল্লেখ করা হয়। প্রতিমন্ত্রী বিদেশ থেকে ফিরে গত ২২ জানুয়ারি এনার্জিপ্যাকের অটো গ্যাস স্টেশনের অনুমতি না দিয়ে এ ধরনের অনুমোদনের ক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে নথি উপস্থাপন করার বাধ্যবাধকতার কথা স্মরণ করিয়ে দেন।
অবৈধ এনার্জিপ্যাক প্রসঙ্গে বিপিসির আপত্তি পাত্তা দেননি সচিব
এর আগে এনার্জিপ্যাককে অটো গ্যাস স্থাপনের প্রাথমিক অনুমোদন না দেওয়ার জন্য চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল বিপিসি। তবে তাতে সায় দেননি জ্বালানি বিভাগের সচিব।
গত ১ জানুয়ারি বিপিসির চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম স্বাক্ষরিত জ্বালানি বিভাগে লেখা চিঠিতে বলা হয়, ‘এলপি গ্যাস অপারেশনাল লাইসেন্সিং নীতিমালার শর্ত পূরণ ছাড়া এনার্জিপ্যাককে অটো গ্যাস স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হলে আরও প্রতিষ্ঠানকেও তা দিতে হবে।’ চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘এনার্জিপ্যাক এলপিজি বোতলজাত প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য ২০১২ সালে জ্বালানি বিভাগের প্রাথমিক অনুমোদন পেয়েছিল। দুই বছরের মধ্যে চূড়ান্ত অনুমোদন নেওয়ার কথা থাকলেও তারা এখন পর্যন্ত তা নেয়নি। নিয়ম থাকলেও তারা বিপিসির সঙ্গে এখনো চুক্তি করেনি। এনার্জিপ্যাক এলপিজির অপারেটর হিসেবে শর্ত ভেঙেছে। এ মুহূর্তে এনার্জিপ্যাককে অটো গ্যাস স্টেশন স্থাপনের অনুমোদন দেওয়ার সুযোগ নেই।’
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বিপিসির এ রকম প্রতিবেদন পাওয়ার পর সচিব নাজিমউদ্দিন চৌধুরী সম্পূর্ণ অবৈধভাবে একক কর্তৃত্বে এনার্জিপ্যাকের নথি অনুমোদনের জন্য উপস্থাপনের মৌখিক নির্দেশ দেন। মৌখিক নির্দেশের তথ্য নথিতেও উল্লেখ করা হয়েছে। বিপিসির আপত্তি আমলে না নিয়ে সচিব মূলত বড় অঙ্কের ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে গত ১৪ জানুয়ারি এনার্জিপ্যাককে দেশজুড়ে ৩০০টি অটো গ্যাস স্টেশন স্থাপনের অনুমতিদিয়ে সই করেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের দুর্নীতি হওয়ায় এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন কাজ শুরু করে দিয়েছে বলেও জানা গেছে। তবে সচিবের কাছ থেকে অনুমতি পাওয়ার পর এনার্জিপ্যাক অটো গ্যাস স্টেশন স্থাপনের কাজ শুরু করে দিয়েছে। যা বন্ধে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ।
এত বড় অফিসিয়াল দুর্নীতির পর প্রতিমন্ত্রী যা বললেন
সরকারের একাধিক উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যেসব অনুমোদন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী পর্যায়ের, সেসব বিষয়ে তাদের এড়িয়ে শুধু সচিব এককভাবে অনুমতি দিতে পারেন না। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে অনুশাসন রয়েছে। মন্ত্রী বিদেশে রয়েছেন, তিনি ফিরলে অবগত করা হবে-এমন প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় সাধারণত দুর্নীতির সহজ পথ বেছে নেওয়ার জন্য। কারণ, অনেক সিদ্ধান্ত রয়েছে যেখানে মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীরা একমত না-ও হতে পারেন। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘আমি এনার্জিপ্যাকের ৩০০ অটো গ্যাস স্টেশনের অনুমতি দিইনি। আমার অনুপস্থিতিতে এই নথি অনুমোদনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাওয়ার নিয়ম আছে। কিন্তু সেটিও হয়নি। আমি দেশে ফিরে এসেও এ নথিতে অনুমোদন দিইনি। এ ধরনের ঘটনা আর যাতে না ঘটে, সে জন্য ভবিষ্যতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেওয়ার জন্য বলেছি।’
সুন্দরবনের দূষণঝুঁকি বাড়বে
সুন্দরবন থেকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূরত্ব মাত্র ১৪ কিলোমিটার। আর সুন্দরবন থেকে এনার্জিপ্যাক এলপি গ্যাসের প্ল্যান্টের দূরত্ব আরও কম, মাত্র সাড়ে ১১ কিলোমিটার। এনার্জিপ্যাকের জি-গ্যাস নামে প্ল্যান্টটি খুলনার সুন্দরবন এলাকায় দাকোপ উপজেলার চুনকুটিতে। পশুর নদের যে পথটি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হবে, সেই একই পথ এনার্জিপ্যাকের প্ল্যান্টের এলপি গ্যাস আমদানির জন্যও ব্যবহৃত হবে। বাংলাদেশ পরিবেশ আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী, কোনো জ্বালানি ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে হলে ওই প্রকল্পের জন্য একটি পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা করতে হয়। আলাদা একটি পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) করতে হয় এর পণ্য পরিবহন ও এর পথ নিয়েও। রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে পণ্য পরিবহন ও সঞ্চালন লাইনের জন্য আলাদা ইআইএ করা হয়েছে। কিন্তু এনার্জিপ্যাকের এই প্রকল্পের জন্য এ ধরনের কোনো ইআইএ করা হয়নি বলে পরিবেশ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা পরিবহনের কারণে সুন্দরবনের ভেতর জাহাজ চলাচল এমনিতেই বাড়বে। তাতে বিশ্বের বৃহত্তম এ শ্বাসমূলীয় বন বহুমাত্রিক ঝুঁকিতে পড়বে বলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক উদ্বেগ আছে। এরই মধ্যে আবার সারা দেশের ৩০০ অটো গ্যাস স্টেশনের জ্বালানি এলপি গ্যাস যাবে খুলনার দাকোপে এনার্জিপ্যাকের স্থাপনা থেকে। এই বিশাল জ্বালানির জোগান সরবরাহ নিশ্চিত করতে এই স্থাপনায় এলপি গ্যাস বেশি করে আমদানি করতে হবে। এতে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচল আরও বাড়বে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ও এনার্জিপ্যাকের জাহাজ চলাচল পুঞ্জীভূত দূষণ বাড়াবে সুন্দরবনে।
অবৈধ গ্যাস সংযোগ
এদিকে প্রায় সাত বছর ধরে সব শ্রেণির গ্রাহককে নতুন গ্যাস-সংযোগ দেওয়া বন্ধ রয়েছে। বিশেষ কিছু ক্ষেত্র ছাড়া পুরোনো গ্রাহকদের গ্যাসের ব্যবহার বাড়ানোর (লোড বৃদ্ধি) অনুমতি দেওয়াও বন্ধ। এরপরও প্রতিবছর গ্রাহকসংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে গ্যাসের ব্যবহারও। জ্বালানি খাতের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, দুর্নীতিবাজ জ্বালানি সচিবের অনিয়ম-দুর্নীতিই এ অবস্থার জন্য দায়ী। জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা পেট্রোবাংলা এবং দেশের সবচেয়ে বড় বিতরণকারী সংস্থা তিতাস গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদনে এই অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। সূত্র বলছে, বর্তমানে দেশে ব্যবহৃত গ্যাসের ৬০ শতাংশের বেশি বিতরণ করে তিতাস। ঢাকাসহ দেশের ১২টি জেলা এবং অধিকাংশ গ্রাহক এই কোম্পানির আওতাধীন। কোম্পানির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত তাদের আবাসিক গ্রাহকসংখ্যা ছিল ২০ লাখ ৬ হাজার ১৩ জন। ২০১৭ সালের জুনে আবাসিক সংযোগসংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৭ লাখ ১৭ হাজার ৫৩৬টি। অর্থাৎ এক বছরেই অবৈধ পন্থায় গ্রাহক বেড়েছে ৭ লাখের বেশি। যা শতাংশের হিসাবে প্রায় ৩৫%। এই হারে এর আগে আর কখনো আবাসিক খাতে গ্রাহক বৃদ্ধির রেকর্ড নেই। যদিও সরকার ২০১০ সালের মধ্যভাগ থেকে শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে এবং ওই বছরের শেষ ভাগে আবাসিক খাতে গ্যাসের নতুন সংযোগ দেওয়া বন্ধ রাখে। ক্রমবর্ধমান চাহিদার তুলনায় সরবরাহ স্বল্পতাই ছিল এর কারণ। কিন্তু তখন থেকে বিশেষ করে আবাসিক খাতে ব্যাপকভাবে অবৈধ সংযোগ দেওয়া হতে থাকে। এ অবস্থায় একবার নির্দিষ্ট সময় দিয়ে আবাসিক খাতের অবৈধ সংযোগ বৈধ করার জন্য সংযোগ বন্ধের আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। এরপর আবার তা বন্ধ করা হয়, যা এখনো বহাল রয়েছে। কিন্তু শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে ২০১০ সালে বন্ধ করার পর আর নতুন সংযোগ চালু করা হয়নি। তবে এই খাতে বিশেষ ক্ষেত্রে, জরুরি প্রয়োজন বিবেচনায় কোনো সংযোগ দেওয়ার জন্য উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি করা হয়। অনেক শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এই কমিটির কাছে আবেদন করে হাজার খানেক নতুন সংযোগ ও লোড বৃদ্ধির অনুমোদন পেয়েছে। এ কারণে যেটুকু চাহিদা বাড়ার কথা, বেড়েছে তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি। পেট্রোবাংলার সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে প্রতিবছর শিল্প, বাণিজ্যিক ও আবাসিক খাতে গ্যাসের চাহিদা বেড়েছে।
অবশ্য এ সম্পর্কে গণমাধ্যমকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় জ্বালানি সচিব সব দায় চাপান সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর। সচিব নাজিমউদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তা ছাড়া গ্যাসের অবৈধ সংযোগ দেওয়া-নেওয়া সম্ভব নয়। তাই সব কোম্পানিকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ১ এপ্রিল থেকে যে কোম্পানির এলাকায় অবৈধ সংযোগ কিংবা অনিয়ম পাওয়া যাবে, সেই কোম্পানির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ দুর্নীতির সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে সচিব বলেন, ‘জ্বালানি খাত একটা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। লাখ লাখ অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। তারপরও সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।’ সরকারি-বেসরকারি সূত্রগুলো জানায়, দুর্নীতিবাজ জ্বালানি সচিবের ছত্রছায়ায় থেকে তিতাসের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের কতিপয় নেতা দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সংযোগ দেওয়া অব্যাহত রেখেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) এ রকম একাধিক অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে।
সচিবকে শাস্তির আওতায় আনার দাবি
সুন্দরবনের আশপাশে কারখানা স্থাপনের অনুমোদন প্রক্রিয়ায় ভুল ছিল বলে মন্তব্য করেছেন পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। ১৯ এপ্রিল বন অধিদফতরে এক কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন। বনমন্ত্রী বলেন, ‘কোনো কারখানা যদি সুন্দরবনের লাল জোন অর্থাৎ ১০ কিলোমিটারের বাইরে হয়, তাহলে সেটি হয়তো সবুজ সংকেত পাবে। কিন্তু কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে এ ধরনের কারখানা যদি সুন্দরবনের অঞ্চল ও নদী ব্যবহার করে, তাহলে কীভাবে সেটি সবুজ হতে পারে? তাই এটি (এনার্জিপ্যাকের অনুমোদন) নিয়েও ভাবতে হবে। আর যে প্রক্রিয়ায় সুন্দরবন এলাকায় কারখানা স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়েছে, তা সঠিক ছিল না বলেই মনে হয়। তাই সুন্দরবনকে রক্ষা করতে হলে মন্ত্রণালয়ে সুন্দরবন স্পেশাল ইউনিট করতে হবে। ভবিষ্যতে সুন্দরবনে শিল্পায়নের অনুমতি দিতে হলে সঠিকভাবে কারিগরি দিক বিবেচনা করতে হবে।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক সুলতানা কামাল বলেন, ‘এটা তো স্পষ্টতই অনিয়ম। নিয়মবহির্ভূতভাবে জ্বালানি বিভাগের সচিব কীভাবে এই অনুমোদন দিলেন, তা খতিয়ে দেখতে হবে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীকে। বিধিবহির্ভূত অনুমোদন দেওয়ায় আইনের আওতায় আনতে হবে সচিবকে।’
