♦ ঘুরে ফিরে আলোচনায় ১৪ নাম ♦ গ্রেফতার আরও দুজন রিমান্ডে ♦ নির্দোষ কাউকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না : ডিবি প্রধান
নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর শাহজাহানপুরে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে সরিয়ে দিতে আন্ডারওয়ার্ল্ডে হয় নয়া মেরুকরণ। সিদ্ধান্ত অনুসারে ভাড়াটে খুনিদের দিয়েই বাস্তবায়ন করা হয় কিলিং মিশন। তাদের অনেকেই সরাসরি অংশ না নিলেও নেপথ্য থেকে মদদ দিয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টিপু হত্যাকাণ্ডের পরপরই নয়া মেরুকরণের বিষয়টি আলোচনায় এলেও অনেকেই আমলে নিতে চাননি। সর্বশেষ মারুফ রেজা সাগরকে গ্রেফতার করার পর বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে উঠল। সাগর কারাবন্দি একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। এর বাইরেও একের পর এক গ্রেফতারকৃতদের জবানী থেকে এই বিষয়টিই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। ঘুরে ফিরে আলোচনায় আসছে ১৪টি নাম। গ্রেফতার না হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে একজন মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের একজন সভাপতির নাম গ্রেফতারকৃত একাধিক আসামির জবানীতে এসেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে, টিপু হত্যা মামলার অন্যতম সন্দেহভাজন সোহেল শাহরিয়ার ওরফে শটগান সোহেল এবং হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র সরবরাহকারী মারুফ রেজা সাগরকে আদালতের নির্দেশে দুই দিন করে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। পুলিশের দাবি, সোহেল এ ঘটনায় মাস্টারমাইন্ড আর সাগর অস্ত্র সরবরাহকারী।
একাধিক সূত্র বলছে, টিপু কিলিং মিশন বাস্তবায়ন করতে কানাডায় অবস্থানরত শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ মানিক, ইউরোপে অবস্থানরত দুই সহোদর বিকাশ কুমার বিশ্বাস ও প্রকাশ কুমার বিশ্বাস শুরুতে একমত হন। পরবর্তীতে এলাকায় আধিপত্য ও ভাগবাটোয়ারা নিয়ে টিপুর সঙ্গে বিরোধ ছিল এমন কারাবন্দি দুই শীর্ষ নেতাসহ স্থানীয় আরও অন্তত পাঁচজন নেতার মতামত নেয় পরিকল্পনাকারীরা। রিয়াজুল হক খান মিল্কি খুনের পর মামলার আসামি হিসেবে টিপুর ক্ষমতায় ভাটা পড়লেও ক্যাসিনো অভিযানের পর আবারও সদর্পে ফিরেন টিপু। মতিঝিল এলাকার চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, স্কুল-কলেজের ভর্তিবাণিজ্য, বাজার নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে টিপুর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন অনেকেই। মতিঝিলের ক্রীড়া ভবনের ঠিকাদার সমিতির সভাপতি হওয়ায় টিপুর কাছ থেকে ওই ভবনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়াও ছিল তাদের অন্যতম টার্গেট। এর বাইরে মতিঝিল এলাকায় জাহিদুল ইসলাম টিপুর একক আধিপত্য বিস্তারকে আগামী দিনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনেকের পথের কাঁটা হতে পারেন বলে মনে করছিলেন তারা। গতকাল দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার হারুন-অর রশিদ বলেছেন, টিপু এবং শিক্ষার্থী সামিয়া আফরান প্রীতি হত্যার ঘটনায় নির্দোষ কাউকে গ্রেফতার কিংবা হয়রানি করা হচ্ছে না। আমরা পারিপার্শ্বিকতা, সাক্ষ্যপ্রমাণ ও আগে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে যাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছি কেবল তাদেরকেই গ্রেফতার করেছি। আমি মনে করি অন্যায়ভাবে কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না। তবে নিহত টিপুর স্ত্রী ফারহানা ইসলাম ডলি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে কারা কারা জড়িত ছিল এ বিষয়টি আমরা জানতে চাই। এখনো অস্ত্র উদ্ধার হয়নি গ্রেফতার হয়নি মোটরসাইকেল চালক। গ্রেফতারকৃতরা যাদের নাম বলেছে তাদের গ্রেফতার করা হোক। জড়িত না হলে আদালত এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিবেন।
টিপু হত্যায় মোটরসাইকেল চালক মোল্লা শামীমের নামটি বহুল আলোচিত ছিল। তার বিষয়ে গোয়েন্দা প্রধান বলেন, টিপু হত্যার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত নয় তাদের কাউকে ধরা হবে না। কিন্তু যারা জড়িত তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে। এই ঘটনায় যারা মাস্টারমাইন্ড ও কিলার তাদের সবাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমরা দ্রুত এ মামলার চার্জশিট দেব। হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের টিম এ বিষয়ে কাজ করছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা বলেন, টিপু হত্যা মামলার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আরও কয়েকজনকে খোঁজা হচ্ছে। যাচাই বাছাই চলছে একজন ওয়ার্ডের নেতা এবং আরেকজন মহানগর নেতার বিষয়টি।
জানা গেছে, শটগান সোহেল মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। দীর্ঘদিন কানাডায় ছিলেন। এক বছর আগে দেশে আসেন। ২০১৬ সালে কানাডায় পাড়ি জমান। সেখানে তিনি স্বেচ্ছাসেবক লীগ কানাডা শাখার সাধারণ সম্পাদক পদ পান। ২০১৯ সালে ক্যাসিনোতে অভিযান চালানোর পর সোহেল দেশে ফিরেন। মতিঝিল এলাকার রাজনৈতিক ও আন্ডারওয়ার্ল্ডে একক আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেন। টিপু হত্যাকাণ্ডে অস্ত্র সরবরাহ করেন মারুফ রেজা সাগর। সাগর এক সময় নিহত রিয়াজুল মিল্কির গাড়ি চালক ছিলেন। গ্রেফতার এড়াতে এই দুজনই কানাডায় যেতে চেয়েছিলেন। গত শনিবার গ্রেফতাররা হচ্ছেন, আরিফুর রহমান সোহেল মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক, খায়রুল আলম যুগ্ম আহ্বায়ক, জুবের আলম খান রবিন জাতীয় পার্টির নেতা ও মাহবুবুর রহমান টিটু সাবেক ছাত্রলীগ নেতা। টিটু ১০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মারুফ আহমেদ মনসুরের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত।
গত ১ এপ্রিল টিপু হত্যায় জড়িত সন্দেহে চারজনকে গ্রেফতার করেছিল র্যাব। তারা হলেন- ১০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক, আবু সালেহ শিকদার ওরফে শুটার সালেহ, নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির ও মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্যা পলাশ। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
র্যাব জানায়, ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুর আস্থাভাজন রিজভী হাসান ওরফে বোচা বাবুকে হত্যা করা হয়। সেই হত্যাকাণ্ডের মামলায় টিপু হত্যা মামলায় গ্রেফতার চারজনই আসামি ছিলেন। সেই হত্যাকাণ্ডেও অন্যতম ভূমিকা পালন করে আরেক সন্ত্রাসী মুসা।
প্রসঙ্গত, গত ২৪ মার্চ রাতে শাহজাহানপুরের আমতলী এলাকার রাস্তায় অস্ত্রধারীর গুলিতে নিহত হন জাহিদুল ইসলাম টিপু। তার মাইক্রোবাসের পাশে রিকশায় থাকা বদরুন্নেছা সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী সামিয়া আফনান প্রীতিও গুলিতে নিহত হন। আহত হন টিপুর গাড়িচালক মুন্না। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গত ২৬ মার্চ রাতে বগুড়া থেকে শুটার মাসুম মোহাম্মদ ওরফে আকাশকে গ্রেফতার করে ডিবি।