জাহিদ হাসান খান রনি: ভন্ডপীর কাসেমীর থেকে অর্থ লেনদেন করে তার সকল অপকর্মের শেল্টার দেন মিরপুর মডেল থানার ওসি এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই থানা এলাকায় একজন পীর নামীয় লোক বিভিন্ন অপকর্ম করেও পার পেয়ে যাচ্ছে অথচ থানার পুলিশ তার ব্যপারে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। মিরপুর মডেল থানার ওসিকে তার অপকর্মের ব্যপারে একাধিকবার এলাকাবাসী জানালেও ওসি নিরব ভ‚মিকায় রয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, মিরপুর মডেল থানার ওসিকে মাসোয়ারা দিয়ে ভন্ডপীর কাসেমী তার বিভিন্ন অপকর্ম অব্যাহত রেখেছে। ওসি‘র শেল্টারেই এই ভন্ডপীর ওই এলাকায় একটি সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তুলেছেন। এই বাহিনী দিয়েই তার বিরুদ্ধে কথা বলা লোকজনকে মারধর সহ হুমকি দামকি দিয়ে দাবিয়ে রাখেন ভন্ডপীর কাসেমী। ভন্ডপীর কাসেমীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ডের অভিযোগ থাকলেও পুলিশ প্রশাসন এক ধরনের নির্বিকার হয়ে পড়ছে। তদন্ত করে তার অপকর্মের প্রমাণও পেয়েছে পুলিশ।
রাজধানীর মিরপুর থানার ১৩ নং ওয়ার্ড এর দক্ষিণ পীরেরবাগ এলাকার কথিত পীর নামীয় মুফতি বরকত উল্লাহ কাসেমীর বিরুদ্ধে অসামাজিক, অনৈতিক ও রাষ্ট্রবিরোধী ত্রাস সৃষ্টিকারীসহ নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে পীরেরবাগ বাড়ীর মালিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশের মহা পরিদর্শক, পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) সহ সরকারের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেন। ইতিমধ্যে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে তার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। উপ-পুলিশ কমিশনার মিরপুর বিভাগীয় কার্যালয়ে এ তদন্ত প্রতিবেদনটি জমা দিয়েছেন তদন্ত টিমের প্রধান মিরপুর বিভাগের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ আলমগীর হোসেন পিপিএম। তদন্ত প্রতিবেদনে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হলেও এ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এদিকে উক্ত অভিযোগে ভন্ড পীর বরকত উল্লাহ কাসেমীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে ফুঁসে উঠেছে এলাকাবাসী। তবে ভন্ডপীর বরকত উল্লাহ কাসেমী তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। জানা গেছে, গত বছরের ২৪ আগস্ট বরকত উল্লাহ কাসেমীর বিরুদ্ধে পীরেরবাগ বাড়ীর মালিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি আলহাজ মো: আব্দুস সোবহান ও সাধারণ সম্পাদক আলহাজ মো: আবুল কালাম স্বাক্ষরিত একটি লিখিত অভিযোগ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে দাখিল করেন। অভিযোগে উল্লেখ করেছেন, মুফতি বরকত উল্লাহ কাসেমী দক্ষিণ পীরেরবাগ বাইতুন নুর জামে মসজিদের খতিব ছিলেন। খতিব থাকাকালে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপকর্মের এবং রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের জন্য খতিব পদ থেকে তাকে অপসারণ করা হয়। পরে সে এলাকার মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করার জন্য অত্র এলাকার ধর্মপ্রাণ জনসাধারণের কাছ থেকে টাকা পয়সা সংগ্রহ করে জমি ক্রয় করে তিনতলা বিল্ডিং করেছে। উক্ত ক্রয়কৃত জমি মাদরাসা ও মসজিদের নামে ওয়াকফ করে দেওয়ার কথা থাকলেও অদ্যাবধী ওয়াকফ করে দেয়নি। অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, এই মসজিদ ও মাদরাসার নাম ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ধর্মপ্রাণ মুসলমান ভাইদের বোকা বানিয়ে তাদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে নিজের নামে কয়েকটি ফ্ল্যাট ক্রয় করেছে। এছাড়া সে গ্রামের বাড়িতে নিজের নামে ও তার স্ত্রীর নামে অনেক সম্পত্তি ক্রয় করেছেন। যাকাত, ফেতরা, মান্নত, কোরবানির চামড়া সব সংগ্রহ করে নামে মাত্র মসজিদ ও মাদরাসায় খরচ করে বাকি সম্পূর্ণ অর্থ নিজের নামে সম্পদ বর্ধিত করছে। এছাড়া ওই মসজিদ ও মাদরাসায় নামে মাত্র তার নিজের বানানো একটি কমিটি আছে, সেখানে গত তিন বছরে একটি মিটিংও দেননি এবং কোন আর্থিক হিসাবও মসজিদের কাউকে দেননি। তবে ধনবান লোকদের কাছ থেকে দান নেওয়ার জন্য মাঝে মধ্যে তিনি মাদরাসা মসজিদ প্রাঙ্গনে সভার আয়োজন করেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। এদিকে বরকত উল্লাহ কাসেমীর বিরুদ্ধে গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ আরেকটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন পীরেরবাগ বাড়ী মালিক কল্যাণ সমিতি’র সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক এবং এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে অভিযোগ দিয়েছেন স্থানীয় ব্যক্তি মো: আবুল কালাম আজাদ। এলাকাবাসীর অভিযোগ, বরকত উল্লাহ কাসেমী নিজেকে স্বঘোষিত পীর নাম ধারণ করে দীর্ঘ দিন থেকে পানি পড়া, ভ‚য়া তাবিজ পড়া ও কুফুরী কালামের মাধ্যমে মানুষের ক্ষতি করছে এবং রাজারবাগ পুলিশের ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা নিয়ে মানুষের সাথে দীর্ঘদিন যাবৎ প্রতারণা করে আসছে। শুধু তাই নয়, এলাকার সর্বস্তরের জনগনের টাকা দিয়ে মসজিদ মাদরাসা গড়ে তুলে তার ভাই, ভাতিজা, শ্যালক ও আত্মীয় স্বজনকে নিয়ে আল্লাহ্’র ঘর মসজিদকে ব্যক্তিগত পীরের খানকা হিসাবে ব্যবহার করছে ভন্ডপীর বরকত উল্লাহ কাসেমী। অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, জনগনের কষ্টার্জিত দানের টাকায় গড়ে তোলা মসজিদ প্ল্যানটি আবাসিক হিসেবে পাস করিয়েছেন ধর্ম ব্যবসায়ী বরকত উল্লাহ কাসেমী। তাই তার বিরুদ্ধে অবৈধ ও অনৈতিক কার্যকলাপ ও প্রতারণাসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরে তার প্রতিবাদে এলাকাবাসী গত বছরের ২০ আগস্ট কয়েক হাজার পোষ্টার লাগায়। কিন্তু তার অনুসারীরা পরদিন সব পোষ্টার ছিড়ে ফেলে দেয়। এই পোস্টার ছিড়তে তিনি নিজেও যান বলে জানা গেছে। তার ৬দিন পর এলাকার সর্বস্তরের মানুষ ও বাড়ির মালিক কল্যাণ সমিতির প্রতিনিধিরাসহ বরকত উল্লাহ কাসেমীর বিরুদ্ধে একটি শান্তিপূর্ণ মিছিল সমাবেশ করেন। এ সময় বরকত উল্লাহ কাসেমীর সন্ত্রাসী বাহিনীরা মিছিলে অতর্কিত হামলা চালায়। এতে বহু মানুষ আহত হয় এবং অনেক ঘর ভাংচুর করে তান্ডব সৃষ্টি করেন। পরে প্রায় দেড় ঘন্টা পর মিরপুর মডেল থানার পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, দুদক ও মিরপুর মডেল থানায় অভিযোগ দায়ের করলেও বরকত উল্লাহ কাসেমীর ভয়ে গণমাধ্যমের সামনে প্রকাশ্যে কথা বলার সাহস পাচ্ছে না কেউ। তারা বলছেন, তিনি নিজে একজন প্রভাবশালী, এবং এলাকার অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে তার চলাফেরা আছে। তার বিরুদ্ধে এর আগে যারা কথা বলেছেন তাদেরকে হত্যার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন কাসেমীর লোকজন। এছাড়া টাকা দিয়ে প্রশাসনকে ম্যানেজ করার ক্ষমতাও রাখেন তিনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, বরকত উল্লাহ কাসেমী একজন ভন্ড পীর হিসেবে এলাকায় পরিচিত। তিনি মানুষের সাথে দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণা করে আসছেন। তার ভয়ে এলাকার অনেক মানুষ কোনো কথা বলতে সাহস পায় না। একজন মুসলমান হয়ে এমন ধর্ম ব্যবসায়ীকে কখনো মেনে নেওয়া যায় না। এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং দুদুক চেয়ারম্যান বরাবর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিরপুর বিভাগ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। পরে গত বছরের ২২ অক্টোবর এই কমিটির প্রতিবেদন উপ-পুলিশ কমিশনার মিরপুর বিভাগীয় কার্যালয়ে জমা দিয়েছেন তদন্ত টিমের প্রধান মিরপুর বিভাগের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ আলমগীর হোসেন পিপিএম। পুলিশের প্রতিবেদনে জানা গেছে, বরকত উল্লাহ কাসেমী দক্ষিণ পীরেরবাগ বাইতুন নুর জামে মসজিদের খতিব থাকাকালে তারাবি নামাজ পড়ানোর হাদিয়া হিসেবে তাকে ৫ হাজার টাকা দিলে ৭ হাজার টাকা না দেওয়ায় সে ২ বার ওই টাকা ফেরৎ দেয় এবং মসজিদ কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে কটুক্তি করেন। এছাড়া মসজিদে জানাজার নামাজ নিয়ে মিথ্যাচার এবং বাইতুন জামে মসজিদের বিভিন্ন বিষয়ে অনিয়মের কারণে মসজিদ কমিটি তাকে অব্যাহতি প্রদান করেন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর ২৪ এপ্রিল ২০১২ তারিখে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় বরকত উল্লাহ কাসেমী বিবৃতি দেয়। সেখানে ছাপা হয়, ইলিয়াস আলীকে ফেরত পাওয়ার আগ পর্যন্ত ১৮ দলীয় জোটকে হরতাল চালিয়ে যেতে হবে, তা না হলে ১৮ দলীয় জোটের ১৮ নেতাকে পর্যায়ক্রমে হাসিয়া সরকার গুম করবে। ইলিয়াস আলী সরকারের হাতেই আছে। ইলিয়াস আলীকে উদ্ধারের জন্য সরকারের পক্ষে জনগণ। এছাড়া বরকত উল্লাহ কাসেমী সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া আরও উল্লেখ করা হয়, জনগণের টাকা নিয়ে মাদরাসার নামে জমি ক্রয় না করে তার নামে জমি ক্রয় করে। পরে এলাকাবাসীর তোপের মুখে ক্রয়কৃত জমি মাদরাসা ও মসজিদের নামে ওয়াকফ করে দেওয়ার মৌখিক স্বীকারোক্তি দেন তিনি। এছাড়া, বরকত উল্লাহ কাসেমী তার সাঙ্গপাঙ্গ সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে গ্রামবাসীর মিছিলে অতর্কিত হামলা করে উল্লেখ করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এদিকে তদন্ত প্রতিবেদন পর্যবেক্ষণ শেষে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বরকত উল্লাহ কাসেমীর কর্মকান্ড নজরদারীতে আনা এবং সরকার বিরোধী বা আইনশৃঙ্খলা বিরোধী কোন কর্মকান্ডের তথ্য পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মিরপুর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশ প্রদান করেন। এ ব্যাপারে পীর মুফতি বরকত উল্লাহ কাসেমীর কাছে জানতে চাইলে তিনি তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। একটি মহল তাকে উৎখাত করার জন্য মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য দিয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, এগুলো সম্পূর্ণ অসত্য একটি অভিযোগ। এটা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছেন, আমার কোন বাহিনী নেই, তাদের পোষ্টার তারা নিজেরাই ছিড়ে ফেলেছে। এবং সে ইলিয়াস আলীকে ফেরত পেতে পত্রিকায় কোন বিবৃতি দেয়নি বলেও জানান। তার বিরুদ্ধে দেওয়া পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন সম্পূর্ণ মিথ্যা বলেও দাবি করেন বরকত উল্লাহ কাসেমী।