তদন্ত চত্র ডেস্ক: চলতি বছরের ২৪ এপ্রিল অ্যালকোহল পান করে অসুস্থ হয়ে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন আটজন। এদের মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনজন, বাকি পাঁচজন সুস্থ হয়ে ঘরে ফেরেন। মদের বিষক্রিয়ায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা। মদে ইথাইলের পরিবর্তে মিথাইল অ্যালকোহল বেশি মেশানো এই বিষক্রিয়ার কারণ।
বিষাক্ত মদপানে মৃত্যুর ঘটনা সারাদেশে ঘটছে দশকের পর দশক। তবে প্রতিবছর বিষাক্ত মদপানে কতজন মারা যায় তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র বলছে, ১৯৯৮ সালে গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জে বিষাক্ত মদপানে ৭১ জন মারা যান। পরের বছর ১৯৯৯ সালের মে মাসে নরসিংদীতে বিষাক্ত মদপানে ১১৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০০০ সালে বগুড়ায় মারা যান ২২ জন।
গত কয়েক বছরেও দেশের বিভিন্ন স্থানে বিষাক্ত মদপানে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ২০২০ সালে দিনাজপুরে বিষাক্ত মদপানে ১০ জন, রংপুরে ৯ জন, লালমনিরহাটে একজন মারা যান। ২০২১ সালে বগুড়ায় বিষাক্ত মদপানে ৯ জন, নারায়ণগঞ্জে তিনজন, ঢাকা ও গাজীপুরে মারা যান ১৩ জন। ২০২৩ সালে এখন পর্যন্ত কিশোরগঞ্জে পাঁচজন এবং ঝিনাইদহে দুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশে ২০২১ সাল পর্যন্ত মদপানের লাইসেন্স রয়েছে ৮৫ হাজার ৭০ জন ব্যক্তির। এর মধ্যে দেশি মদপানের অনুমতি ৬৬ হাজার ৩৫১ জনের আর বিদেশি মদ পানের অনুমতি রয়েছে ১৮ হাজার ৭১৯ জনের। এর মধ্যে পুরুষ ৮৪ হাজার ২১১ জন এবং নারী এক হাজার ৮৫৯ জন। দেশি মদ তৈরির অনুমোদন রয়েছে ২০৪টি প্রতিষ্ঠানের। এর মধ্যে চালু রয়েছে ১৯৬টি, বন্ধ আটটি। কোনো কোনো জেলায় একাধিক আবার কোনো কোনো জেলায় একটিরও অনুমোদন নেই। অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান দেশি মদ তৈরি করে বিক্রি করে। এর বাইরে যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে সঠিক পদ্ধতি না মেনে দেশি মদ তৈরি করে সেগুলো বিষাক্ত হয়ে যায়। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব মদ পান করেই মারা যায় মানুষ।
মাদকের বিভিন্ন ধরনের মধ্যে দেশি-বিদেশি মদের বিস্তার বেশি ঘটেছে গত এক যুগে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত ১২ হাজার ৯৪ লিটার দেশি মদ এবং দুই লাখ ৪০ হাজার ৫৪৬ লিটার চোলাই মদ জব্দ করেছে।
শুধু দেশি মদই নয়, অবৈধভাবে আসা বিদেশি মদও জব্দ করছে অধিদপ্তরটি। অধিদপ্তরের তথ্যমতে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, র্যাব, বাংলাদেশ কোস্টগার্ড চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সারাদেশে এক লাখ ১০ হাজার ৩২৭ বোতল এবং তিন হাজার ৪৪৯ লিটার বিদেশি মদ জব্দ করেছে।
এছাড়া ২০১৯ সালে এক লাখ ১৩ হাজার ২৭৯ বোতল ও একশ লিটার বিদেশি মদ, ২০২০ সালে এক লাখ ৩২ হাজার ৫৩৯ বোতল ও ৬০৬ লিটার, ২০২১ সালে দুই লাখ ২৫ হাজার ৩২৮ বোতল ও তিন হাজার ২৫ লিটার, ২০২২ সালে দুই লাখ ৭৩ হাজার ৫৮০ বোতল ও তিন হাজার ৯১৯ লিটার বিদেশি মদ জব্দ করা হয়। অর্থাৎ, দেশে বছরে গড়ে এক লাখ ৭৫ হাজার বোতল ও লিটার বিদেশি মদ বিভিন্ন সময় জব্দ হয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশি-বিদেশি মদ অনেক আগে থেকেই ছিল। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকেই অবৈধ দেশি-বিদেশি মদ জব্দ করে সেগুলো ধ্বংস করা হয়। কয়েক দশক ধরেই বিষাক্ত মদে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। সঠিক মাত্রায় ও পদ্ধতিতে অ্যালকোহল দিয়ে এসব মদ তৈরি না করায় প্রতি বছরই মৃত্যু হচ্ছে। ফলে এসব ঘটনা যেন আর না ঘটে আমরা সেটার ওপর গুরুত্ব দিয়ে অবৈধ দেশি-বিদেশি মদ জব্দ ও মৃত্যুর ঘটনাগুলোর তথ্য-উপাত্ত নিয়ে প্রয়োজনীয় সচেতনতা তৈরির কাজ করছি।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ এর ১০ ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি লাইসেন্স, অনুমোদন বা পাস ছাড়া কোনো অ্যালকোহল কারখানা স্থাপন, অ্যালকোহল উৎপাদন-প্রক্রিয়াজাতকরণ, বহন, পরিবহন, আমদানি-রপ্তানি, সরবরাহ, বিপণন, ক্রয়-বিক্রয়, ধারণ, অধিকার-দখল, সংরক্ষণ, গুদামজাতকরণ-প্রদর্শন, সেবন, প্রয়োগ ও ব্যবহার করতে পারবে না।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা) কাজী আল আমিন বলেন, অনুমতি ছাড়া যারা এই মাদক বিক্রি করে তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলে। বিষাক্ত মদ পান করে মারা যাওয়ার কারণ এসব মদে অতিরিক্ত মাত্রায় অ্যালকোহল ব্যবহার করা হয়, যা পান করার মতো নয়।
অবৈধভাবে উৎপাদিত দেশি-বিদেশি যেসব মদে মিথাইলের ব্যবহার বেশি সেসব মদ পান করেই মারা যাচ্ছেন অনেকে। এমনকি এসব মদ যারা পান করছেন তাদের মধ্য থেকেই কেউ কেউ ক্যানসার, লিভার সিরোসিসসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ও দ্য মেডিকোলিগ্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের মহাসচিব ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, মদপানে মৃত্যুর ঘটনায় যে মরদেহগুলো আসে সেগুলো সাধারণত বিষপানে মৃত্যু হয়েছে- এমনটা ধারণা করে আনা হয়। পরে ময়নাতদন্ত করে দেখা যায় বিষাক্ত মদপানের ফলে মৃত্যু হয়েছে। অবৈধভাবে যেসব ব্যবসায়ী ইথাইল অ্যালকোহলের পরিবর্তে মিথাইল অ্যালকোহল বেশি মিশিয়ে মদ তৈরি করে তখন সেই মদ পান করলে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়। এছাড়া দীর্ঘদিন যারা মদপান করেন তারা লিভার সিরোসিস, ক্যানসারের মতো বিভিন্ন রোগে মারাও যান।