
নিজস্ব প্রতিবেদক, বগুড়াঃ ২২ বছরের যুবক বশির উল্লাহ সরদার গোপালগঞ্জের একটি সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তার সহযোগী ১৯ বছরের আজহার উদ্দিন আবির চাঁদপুর সরকারি কলেজের ছাত্র। ফ্যাবিহ্যাক্সর (FabiHaxor) ও রুট স্ক্রিপ্ট (Root Script) ছদ্মনামে গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে দেশে সরকারি এবং বড় প্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু ওয়েবসাইট হ্যাক করে তারা। উদ্দেশ্য ওয়েবসাইটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেটা আন্তর্জাতিক হ্যাকার পেজ ‘জন-এইচএ’ ফাঁস করা। একই সঙ্গে তারা বাংলাদেশের হ্যাকারদের শক্তিশালী গ্রুপ ‘ব্ল্যাক ওয়েব’এর সদস্য।
ব্ল্যাক ওয়েব টিম এ পর্যন্ত দেশি-বিদেশি প্রায় তিন হাজার ৬৮৯ ওয়েবসাইট হ্যাক করেছে। আন্তর্জাতিক হ্যাকার পেজ ‘জন-এইচএ’ এর সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে তাদের। আবিরের ব্ল্যাকওয়েবের সঙ্গে অর্ধশতাধিক তরুণ কাজ করে। আবিরের কাছ থেকে জব্দ করা কম্পিউটারে হ্যাকিং সম্পর্কিত ৩৬ গিগাবাইট ফাইল ও ওয়েবসাইট হ্যাকিংয়ের বিভিন্ন টুলস পাওয়া যায়। দেশে একযোগে ২১ ওয়েবসাইট হ্যাক হৈ চৈ ফেলে দেয়। সম্প্রতি বগুড়া সাইবার পুলিশের অভিযানে ভন্ডুল হয়ে যায় তাদের দেশ বিরোধী এ চক্রান্ত।
মির্জা শামীম হাসান সনি। কখনো প্রকৌশলী, কখনো আইনজীবী, আবার কখনো সাংবাদিক, লেখক, কবি! যখন যেমন প্রয়োজন, তখনই এমন সব কৌশলী পরিচয়ে হাজির হন তিনি। তবে যে পরিচয়টা এতদিন কাউকে ঘুণাক্ষরেও জানতে দেননি, সেটাই খুঁজে বের করেছে বগুড়ার সাইবার ক্রাইম পুলিশ। সনি একজন বিকৃতমনা ধূর্ত সাইবার অপরাধী। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের নামে ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে কুৎসা ছড়ানো, ছবি দিয়ে মানহানিকর মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে চাতুরি করাই তার এক অদ্ভুত নেশা। তাকে গ্রেফতারের মাধ্যমে সাঙ্গ হয় বিকৃতমনা সাইবার অপরাধীর অশুভ তৎপরতা।
বগুড়াসহ দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন গুরুতর অনলাইন থ্রেট নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে বগুড়ার সাইবার পুলিশ। মাত্র তিন বছরে তাদের সফলতার ঝুলিও বেশ বড়। আর সম্প্রতি সাইবার আপরাধের শিকার ভুক্তভোগীদের জন্য রীতিমতো আশার আলো হয়ে উঠেছে পুলিশের এ কার্যক্রম।
বৃষ্টি চেীধুরী একজন গৃহবধূ। ঘনিষ্ঠ বান্ধবীদের কাছে একদিন ব্যক্তিগত কিছু ছবি শেয়ার করেন। দৈবক্রমে সেই ফোনটি নষ্ট হলে চলে যায় মেকারের হাতে। সেখান থেকেই কপি হয়ে যায় সব ছবি। এরপর বৃষ্টি চেীধুরীর ব্যক্তিগত ছবিগুলো ব্যবহার করে তৈরি হয় পর্নো সাইটের পেজ। তাতে মোবাইল নম্বরও দেয়া হয়। এরপর থেকে রাতদিন হয়রানি ও আজেবাজে ম্যাসেজে তার জীবন দূর্বিসহ করে তোলে। শেষ পর্যন্ত বগুড়ার সাইবার পুলিশের হস্তক্ষেপে এক বিভীষিকাময় জীবন থেকে মুক্তি পান তিনি।
জানা গেছে, গত তিন বছরে দুই শতাধিক সাইবার অপরাধের নিষ্পত্তি করেছে বগুড়া সাইবার পুলিশ ইউনিট। এসব অভিযোগকারীদের মধ্যে গৃহবধূ ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সংখ্যাই বেশি। এছাড়াও বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্যদের নামে অপপ্রচার,পদ্মা সেতু নিয়ে গুজব ছড়ানোর মত অপরাধীদেরও গ্রেফতার করা হয়।
বগুড়ার পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞার উদ্যোগে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে পরীক্ষামূলকভাবে সাইবার পুলিশের কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুতেই ব্যাপক সাড়া ফেলায় ২০১৯ সালের ২৪ জানুয়ারি রাজশাহী রেঞ্জের তৎকালীন ডিআইজি এম খুরশীদ হোসেন বগুড়ায় এসে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সাইবার পুলিশ বগুড়ার ইউনিটের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। ফেসবুকে গুজব রটানো, রাষ্ট্রবিরোধী প্রচার, জঙ্গি তৎপরতাসহ সাইবার অপরাধ দমনে তৎপর সাইবার পুলিশ ইউনিট। বিশেষ করে ফেসবুক বা অনলাইনভিত্তিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতারণার শিকার নারীরা অভিযোগ নিয়ে আসতে শুরু করে সাইবার পুলিশের কাছে। তাদের পরিচয় গোপন এবং অনেকের পরিবারকে না জানিয়ে সমস্যা সমাধান করা হয়।
বগুড়ার পুলিশ সুপার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সাইবার পুলিশের বিভিন্ন অপরাধ নিষ্পত্তির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো এক গৃহবধূর ঘটনা। ওই গৃহবধূকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক ফেইক (ভুয়া) আইডি থেকে বিরক্ত করা হতো। তিনি বিষয়টি থেকে রক্ষা পেতে পুলিশের সাইবার ইউনিটে অভিযোগ দেন। পরে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ফেক আইডির অ্যাডমিনকে চিহ্নিত করা হয়। দেখা যায় তিনি আর কেউ নন, ওই গৃহবধূরই স্বামী। তাকে অন্য জেলা থেকে আটক করা হয়। বর্তমানে তারা দুজনই (স্বামী-স্ত্রী) ভালো আছেন।
আরেক ঘটনার ভুক্তভোগী গৃহবধূ ফেসবুকে মালেশিয়া প্রবাসী এক যুবকের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন। সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়ে এবং স্বামী বাহিরে গেলে একা বাড়িতে ভিডিও ফোনে চলতো তাদের পরকীয়া। এভাবে এক বছর পার হয়ে যায়। হঠাৎ যুবকটি যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এর কিছুদিন পরেই ওই গৃহবধূ দেখতে পান তার ছবি দিয়ে নতুন একটি ফেসবুক আইডি খোলা হয়েছে। তার পরিচিত অনেকেই অ্যাড হয়েছেন সেই আইডিতে। এ আইডি থেকে তার নগ্ন ছবি ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছিল। এমন ঘটনায় আত্মহত্যা সিদ্ধান্ত নেন তিনি। একপর্যায়ে তার স্বামীর কাছে চলে যায় নগ্ন ছবি। স্বামী বিষয়টি সমাধানের জন্য পুলিশের কাছে যান। পুলিশের সাইবার ইউনিট খোঁজ নিয়ে দেখে ওই আইডি মালেশিয়া থেকে রায়হান নামের এক যুবক চালাচ্ছেন। পরে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ওই ফেক আইডিসহ রায়হানের সব আইডি বন্ধ করে দেয়া হয়।
বগুড়ার পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা বলেন, সাইবার পুলিশের কার্যক্রম শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ২২০ অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়েছে। মামলা হয়েছে ৩৫ এবং অভিযোগকারী মামলা না করায় বিকল্পভাবে নিষ্পত্তি হয় আরও ১৮৫ অভিযোগ। ১৮৫ অভিযোগের অধিকাংশই স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও গৃহবধূ রয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, যেগুলোর মামলা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে সরকারি ওয়েবসাইট হ্যাক, ক্রিপ্টোকারেন্সি, বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার নামে অপপ্রচার, পদ্মা সেতু নিয়ে গুজব ও রাষ্ট্র বিরোধী প্রচারণা, প্রতারণামূলক অর্থ হাতিয়ে নেয়া, কলেজ ছাত্রীর ফেসবুক আইডি হ্যাক করে ইউটিউবে ছবি ও ভিডিও প্রকাশ, পুলিশকে গালিগালাজ করে ফেসবুকে লাইভসহ আরও অনেক সাইবার অপরাধ।
সাইবার থ্রেট-এর আরও একটি বড় মাধ্যম হলো অনলাইনে অর্থ লেনদেন (ক্রিপ্টোকারেন্সি)। বগুড়া সাইবার পুলিশ এই চক্রের ৩ সদস্যকেও গ্রেপ্তার করে অসাধ্য সাধন করে। ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবসায় জড়িত চক্রটি এক শ্রেণির গ্রাহকের কাছ থেকে বিট কয়েন, বিট কয়েন ক্যাশ, লাইট কয়েন, ওয়েবমানি, পারফেক্ট মানি কেনাবেচা করে। গ্রাহক চক্রটির কাছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রথমে টাকা প্রেরণ করে, বিনিময়ে চক্রটি গ্রাহকের চাহিদামত অনলাইন ওয়ালেট বা অ্যাকাউন্টে এ ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রেরণ করে।
চক্রটি কারো কাছে ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রেরণ করে। আবার কারো কারেন্সি না পাঠিয়ে টাকা আত্মসাৎ করে। সাইবার পুলিশ বগুড়া ইউনিট বেশ কয়েকমাস ধরে এমন কিছু বিট কয়েন ব্যবসায়ী চক্রের উপর নজর রাখে। তারা বেশ খোলামেলাভাবে অনলাইনে এ অবৈধ ব্যবসা করে আসছিল। এমনকি গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী তারা বিভিন্ন ক্লায়েন্টকে বিট কয়েন দেয়ার কথা বলে মোটা অংকের টাকাও আত্মসাৎ করেছে।
পুলিশ সুপার বলেন, শুরু থেকে বগুড়ার সাইবার পুলিশ চেষ্টা করেছে সব ধরনের সাইবার থ্রেট নিয়ে কাজ করার। এ কারণে এতো অল্প সময়ে মানুষের প্রশংসা পাওয়া সম্ভব হয়েছে। সিনিয়র কর্মকর্তাদের সহযোগিতার কারণে এসব অর্জন সম্ভব হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
