TadantaChitra.Com | logo

১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বাপ্পী হত্যা মামলায় ‘পলাতক’ আসামী মাদক মামলায় কারাগারে

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৭, ২০২১, ১৪:৪৯

বাপ্পী হত্যা মামলায় ‘পলাতক’ আসামী মাদক মামলায় কারাগারে

চট্টগ্রাম ব্যুরোঃ চট্টগ্রামে চাঞ্চল্যকর আইনজীবী ওমর ফারুক বাপ্পী হত্যা মামলার প্রধান আসামি তার কথিত স্ত্রী রাশেদা বেগম। হত্যাকাণ্ডেরদুদিন পর গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যান তিনি। এরপর অবশ্য জামিন নিয়ে বের হয়ে যান। একপর্যায়ে নিয়মিত হাজিরা না দিলে মামলাটিতে তার বিরুদ্ধে আবার পরোয়ানা জারি করেন আদালত। কিন্তু সেই পরোয়ানা জমা থাকে কক্সবাজারের চকরিয়া থানা পুলিশের হাতে।

এদিকে, পরোয়ানা থাকাকালে ইয়াবাসহ চট্টগ্রাম নগরের গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাতে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যান রাশেদা। দীর্ঘদিন মাদক মামলায় কারাগারে থাকলেও হত্যা মামলার নথিতে এখনো ‘পলাতক’ তিনি। রাশেদার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা থাকার বিষয়টি জানতেন মাদক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) ও বাকলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) অঞ্জন দাশ গুপ্ত।

আসামি গ্রেফতারের ফরোয়ার্ডিংয়ে তিনি রাশেদার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা বিচারাধীন থাকার বিষয়টি উল্লেখও করেছেন। তবে হত্যা মামলার প্রধান আসামি মাদক মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যাওয়ার বিষয়টি তিনি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকেও অবহিত করেননি। যদিও আইও দাবি করেছেন, এটা তার দায়িত্ব নয়। আসামির নাম-ঠিকানা দিয়ে ক্রাইম ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিডিএমএস) পর্যালোচনা করে মামলা থাকার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। তবে আসামি যে ওই মামলায় পলাতক সেটি তিনি জানতেন না। এটি তার জানার সুযোগও ছিল না।

আইনজীবীরা বলছেন, এটা আসামিদের এক ধরনের ছলচাতুরি। সাধারণত কোনো মামলায় গ্রেফতার হলে অন্য মামলায় পরোয়ানা থাকলে আসামির নিযুক্ত আইনজীবীর মাধ্যমে বিষয়টি আদালতকে অবহিত করা দরকার হয়। এক্ষেত্রে আসামিরা সাজার ক্ষেত্রে সুবিধাও পান। কিন্তু রাশেদা একটি চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার আসামি হওয়ায় হয়তো জামিন পাওয়ার সম্ভাবনা কম, তাই বিষয়টি আদালতকে অবহিত করেননি। এক্ষেত্রে মাদক মামলায় জামিন নিয়ে তার নিরুদ্দেশ হওয়ার উদ্দেশ্যও থাকতে পারে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট এস এম দিদার উদ্দিন বলেন, আইনজীবী বাপ্পী আমাদের সহকর্মী ছিলেন। তার হত্যাকাণ্ড চট্টগ্রামের বেশ আলোচিত। ওই হত্যা মামলার প্রধান আসামি মাদক মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছেন বলে শুনেছি। এক্ষেত্রে আসামি রাশেদার উচিত ছিল বিষয়টি তার আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতকে অবহিত করার। কিন্তু হয়তো কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে তিনি তা করেননি। তবে মাদক মামলার আইও চাইলে বিষয়টি খোঁজ নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে অবহিত করতে পারতেন। অথবা তিনি রাশেদার পরোয়ানা থাকা চকরিয়া থানাকেও অবহিত করতে পারতেন। এক্ষেত্রে আসামির অসৎ উদ্দেশ্য হয়তো সফল নাও হতে পারতো।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সর্বশেষ গত সোমবার (১৩ ডিসেম্বর) আইনজীবী বাপ্পী হত্যা মামলায় আদালতে একজন ম্যাজিস্ট্রেট, একজন পুলিশ কনস্টেবলসহ মোট পাঁচজন সাক্ষ্য দেন। ওইদিনও প্রধান আসামি রাশেদাকে পলাতক হিসেবে আদালতে দেখানো হয়েছে। আবার একইদিন মাদক মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তিনি কারাগারে রয়েছেন। সোমবার বিকেলে বাকলিয়া থানার নিবন্ধন কর্মকর্তা (জিআরও) আনিছুর রহমান বলেন, রাশেদা ২৯ সেপ্টেম্বর ইয়াবাসহ গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।

২০১৭ সালের ২৫ নভেম্বর নগরের চকবাজার থানার কে বি আমান আলী রোডে বড় মিয়া মসজিদের সামনে একটি ভবনের নিচতলার বাসা থেকে তরুণ আইনজীবী বাপ্পীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এসময় তার হাত-পা ও মুখ টেপ দিয়ে মোড়ানো এবং স্পর্শকাতর অঙ্গ কাটা অবস্থায় পাওয়া যায়। ঘটনার পর বাপ্পীর বাবা আলী আহমেদ বাদী হয়ে চকবাজার থানায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।

মামলা তদন্তের দায়িত্ব পান বাকলিয়া থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) ইয়াসিন আরাফাত। এদিকে বাপ্পী হত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম আদালতে আইনজীবীরা বিক্ষোভ করতে থাকেন। আইনজীবীদের আন্দোলনের মুখে টানা অভিযান চালিয়ে ঘটনার দুদিন পর ২৭ নভেম্বর কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থান থেকে রাশেদা বেগমসহ মোট ছয়জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। একই সঙ্গে মামলাটি পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিট অধিগ্রহণ করে পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমাকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করে। এরপর তিনি তদন্ত করে বের করেন হত্যার নেপথ্যের কাহিনি।

বাপ্পী ২০১৩ সালে চট্টগ্রাম বারের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। তার গ্রামের বাড়ি বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার চৌমুহনী এলাকায়। তার বাবা আলী আহমেদ। মায়ের নাম মনোয়ারা বেগম। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন ফারুক। হত্যাকাণ্ডের আগ পর্যন্ত তিনি অবিবাহিত ছিলেন বলে জানতেন আত্মীয়-স্বজনরা।

যে বাড়ি থেকে বাপ্পীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে সে বাড়ির কেয়ারটেকার সাংবাদিকদের জানান, ঘটনার কয়েকদিন আগে ওই নারী (রাশেদা) তার স্বামীসহ থাকবেন বলে বাসা ভাড়া নেন। ঘটনার রাতে ওই বাসায় থাকতে যান বাপ্পি। পরে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়

তদন্তকারীরা জানান, দেলোয়ার নামে এক ইয়াবা পাচারকারীর স্ত্রী ছিলেন রাশেদা বেগম। স্বামীর মামলার সূত্র ধরে আইনজীবী বাপ্পীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়। এক পর্যায়ে তারা গোপনে বিয়ে করেন।

আসামিদের গ্রেফতারের পর চট্টগ্রাম মেট্রোর তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মঈন উদ্দিন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার ছয় আসামি হত্যার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তবে তারা জানিয়েছেন, আইনজীবী ওমর ফারুক বাপ্পীকে হত্যার কোনো পরিকল্পনা তাদের ছিল না। রাশেদাকে দুই লাখ টাকা কাবিননামায় বিয়ে করেন বাপ্পী। এ নিয়ে তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন তিনি। সেই টাকা দুই লাখ থেকে বাড়িয়ে ৫-১০ লাখ টাকা করার পরিকল্পনা করেন রাশেদা। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বন্ধু হুমায়ুনের মাধ্যমে চার যুবককে ভাড়া করেন রাশেদা। পরিকল্পনা অনুযায়ী খালি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিতে গিয়ে রাশেদা ওই পাঁচ যুবকের সহযোগিতায় বাপ্পীকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন।

২০১৮ সালে ৫ এপ্রিল পরস্পর যোগসাজশে বাপ্পীকে হত্যার অভিযোগে রাশেদাসহ ছয় আসামির বিরুদ্ধে আদালতকে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ওই সময় রাশেদাসহ ছয় আসামি কারাগারেই ছিলেন।

অভিযোগপত্র দাখিলের পর একপর্যায়ে প্রধান আসামি রাশেদার জামিন হয়। জামিনের পর আদালতে হাজিরা না দিলে আবার তার বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি হয়। সেই পরোয়ানা যায় চকরিয়া থানা পুলিশের হাতে। কিন্তু পুলিশের চোখে পলাতক রাশেদা চালিয়ে যান মাদক ব্যবসা। গত ২৯ সেপ্টেম্বর বাকলিয়া থানার সৈয়দ শাহ এলাকা থেকে আরেক নারী সহযোগীসহ দুই হাজার ১০০ পিস ইয়াবা নিয়ে ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন তিনি।

ডিবি পুলিশ জব্দ ইয়াবাসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে আসামিদের বাকলিয়া থানায় হস্তান্তর করে। এরপর বাকলিয়া থানায় একটি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দায়ের হয়। মামলা দায়েরের পর বাকলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) অঞ্জন দাশ গুপ্ত তদন্তের দায়িত্ব পান। ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি রাশেদাসহ দুই আসামিকে আদালতে পাঠান। তখন তার ফরোয়ার্ডিং কপিতে রাশেদার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা থাকার বিষয়টি উল্লেখ ছিল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই অঞ্জন দাশ গুপ্ত বলেন, আমি সিডিএমএস পর্যালোচনা করে তার বিরুদ্ধে যা পেয়েছি, তা ফরোয়ার্ডিংয়ে উল্লেখ করেছি। মাদক মামলাটি তদন্ত করে আমি ইতোমধ্যে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছি। আসামি এখনো জেলহাজতে আছে। তবে মাদক মামলার আসামি রাশেদা হত্যা মামলায় পলাতক থাকার বিষয়টি আমার জানা ছিল না। আবার এটি আমার জানার সুযোগও ছিল না।

রাশেদার পরোয়ানা জমা থাকার বিষয়ে চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ ওসমান গনি বলেন, চকরিয়া থানায় চার-পাঁচ হাজার ওয়ারেন্ট জমা আছে। এসব আসামির কে কোন দিকে গ্রেফতার হচ্ছে, আমাদের না জানালে আমরা কীভাবে খবর পাবো?

বাপ্পী হত্যা মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী কেশব চন্দ্র নাথ বলেন, রাশেদা মাদক মামলায় গ্রেফতার হওয়ার বিষয়টি আমাকে কেউ অবহিত করেননি। তার বিরুদ্ধে পরোয়ানা রয়েছে এবং সোমবার (১৩ ডিসেম্বর) বাপ্পী হত্যা মামলার ধার্য তারিখ পর্যন্ত তিনি পলাতক ছিলেন।


যোগাযোগ

বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যলয়

কাব্যকস সুপার মার্কেট, ৩ ডি কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫।

মোবাইলঃ ০১৬২২৬৪৯৬১২, ০১৬০০০১৪০৪০

মেইলঃ tadantachitra93@gmail.com, tchitranews@gmail.com

সামাজিক যোগাযোগ

Web Design & Developed By
A

তদন্ত চিত্র কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েব সাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি।