সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা নারী সহকর্মীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে। ঘটনার পর আপস-রফা করতে নানা কাণ্ড ঘটিয়েছেন ওই কর্মকর্তা। কখনও সারাজীবন ‘বড় ভাই’ হয়ে পাশে থাকার প্রস্তাব, কখনও স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভুক্তভোগীর বাসায় বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছাপোষণ করছেন। এমনকি তার মতো আরও ‘বড় ভাই’ ভুক্তভোগীকে জোগাড় করে দেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছেন অভিযুক্ত কর্মকর্তা।
হয়রানির ঘটনা ও আপসের এমন নানা অপচেষ্টায় আরও ভীতসন্ত্রস্ত ভুক্তভোগী। নিজে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন, গর্ভের অনাগত সন্তানকে নিয়েও দুশ্চিন্তায় দিন পার করছেন ওই নারী।
অভিযুক্ত আবুল কালাম আজাদের সহকারী ব্যক্তিগত কর্মকর্তা বিএডিসি চেয়ারম্যান বরাবর এ বিষয়ে অভিযোগ করেছেন। গত ৪ ফেব্রুয়ারি বিএডিসিতে যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে। ঘটনার পরদিন ৫ ফেব্রুয়ারি ভুক্তভোগী লিখিত অভিযোগ দিয়ে প্রতিকার চান। লিখিত অভিযোগে তিনি আতঙ্কে দিন পার এবং শারীরিক-মানসিক অস্বস্তিতে পড়ার কথা উল্লেখ করেন। অনাগত সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কার কথাও জানান।
তবে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগী ও তার সহকর্মীদের। অভিযোগ জমা পড়ার একমাসের বেশি সময় পার হলেও এ নিয়ে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শুধু এক সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। বাধ্য হয়ে গত ৬ মার্চ বিএডিসি উইমেনস অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠানে নারীদের কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে স্মারকলিপি দিয়েছে চেয়ারম্যানকে।
লিখিত অভিযোগে যা জানিয়েছেন ভুক্তভোগী
বিএডিসি চেয়ারম্যানকে দেওয়া ভুক্তভোগীর লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৪ ফেব্রুয়ারি ভুক্তভোগী (সহকারী ব্যক্তিগত কর্মকর্তা) বিএডিসির পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. আবুল কালাম আজাদের কক্ষে যান বদলির বিষয়ে কথা বলতে। একপর্যায়ে আবুল কালাম আজাদ অসৎ উদ্দেশ্যে ভুক্তভোগীকে জড়িয়ে ধরার জন্য কাছে গিয়ে হাত চেপে ধরেন। ঘটনাটি তৎক্ষণাৎ ও অনাকাঙ্ক্ষিত হওয়ায় ভুক্তভোগী ভয় পেয়ে যান এবং নিজেকে সরিয়ে নিয়ে আবুল কালাম আজাদের কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান।
অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ভুক্তভোগী নারী কর্মকর্তা বর্তমানে সাতমাসের অন্তঃসত্ত্বা। ঘটনার পরপরই তিনি বিষয়টি তার স্বামীকে অবগত করেন। তার পুলিশ কর্মকর্তা (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার) ভাইকেও বিষয়টি খুলে বলেন। ভুক্তভোগীর পুলিশ কর্মকর্তা ভাই থানায় বিষয়টি নিয়ে দ্রুত মামলা করতে বলেন।
তবে ভুক্তভোগী বিষয়টি জানাজানি হলে নিজের আত্মসম্মানের বিষয়টি বিবেচনা করে থানায় না গিয়ে বিএডিসি চেয়ারম্যানকে লিখিত অভিযোগ দেন। বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি অভিযোগপত্রে লিখেছেন, ‘আবুল কালাম আজাদের এমন আচরণে আমি খুবই ভীত এবং চিন্তিত। যেখানে এমন সময়ে (সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা) আমাকে মানসিক প্রশান্তিতে থাকার কথা, সেখানে ঘটনার পর আমি একটুও মানসিক ও শারীরিক স্বস্তি পাচ্ছি না, যা আমার ও আমার অনাগত সন্তানের জন্য খুবই ক্ষতিকর। আমি আমার শ্লীলতাহানির জন্য আবুল কালাম আজাদের সঠিক বিচারের দাবি জানিয়ে অভিযোগপত্রটি দাখিল করলাম।’
জানতে চাইলে ভুক্তভোগী বলেন, ‘উনি (আবুল কালাম আজাদ) এখন আমাকে বড় ভাই হওয়ার কথা বলছেন। কিন্তু ওনার সেদিনের আচরণ বড় ভাইয়ের মতো ছিল না। বিষয়টি নিয়ে আমি খুবই আতঙ্কগ্রস্ত এবং আমার গর্ভের সন্তানের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়া নিয়ে শঙ্কায় আছি। আমি এ ঘটনার সঠিক বিচার চাই। কেউ যেন আমার মতো ভুক্তভোগী না হয়, সেটাও বিএডিসিকে নিশ্চিত করতে হবে।’
অভিযোগ তুলে নিতে চাপ
ভুক্তভোগী লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পর আবুল কালাম আজাদ নানাভাবে তাকে অভিযোগ প্রত্যাহারের জন্য চাপ দিয়ে আসছেন। কখনও সহকর্মীদের দিয়ে ভুক্তভোগীকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। কখনও নিজেই ফোন দিয়ে সব মিটমাট করার প্রস্তাব দিচ্ছেন। এ কাজে বেশ কয়েকজন সহকর্মীও তাকে সহযোগিতা করছেন বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী ও তার কয়েকজন নারী সহকর্মী।
ভুক্তভোগীকে ফোন করেও বিষয়টি মীমাংসার অনুরোধ জানান আবুল কালাম আজাদ। ৮ মিনিট ৩০ সেকেন্ডের সেই ফোনকলের রেকর্ড অনুযায়ী, ভুক্তভোগীকে নিজের ‘বোন’ এবং নিজেকে ভুক্তভোগীর সারাজীবনের ‘বড় ভাই’ উল্লেখ করে সব ঠিক করে নেওয়ার জন্য চাপ দেন আবুল কালাম আজাদ। তিনি দুঃখপ্রকাশ করে ক্ষমা চান এবং অভিযোগ তুলে নিতে অনুরোধ করেন। বড় ভাই হিসেবে সারাজীবন পাশে থাকার ও স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভুক্তভোগীর বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। এমনকি তার মতো আরও বড় ভাইয়ের ব্যবস্থা করে দেওয়ার আশ্বাসও দেন তিনি।
তবে বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না বলে দৃঢ়কণ্ঠে বলতে শোনা যায় ভুক্তভোগীকে। ঘটনার দিনের আচরণ ‘বড় ভাই সুলভ’ ছিল না এবং এটা মানতে পারছেন না বলে জানিয়ে দেন ভুক্তভোগী।
বিএডিসির দুজন নারী কর্মকর্তা বলেন, অভিযোগ দেওয়ার পর থেকে আবুল কালাম আজাদ ভুক্তভোগীকে প্রথমে অনুরোধ এবং পরে চাপাচাপি শুরু করেন। সেই কল রেকর্ডও বিএডিসির সবার মোবাইলে ছড়িয়ে পড়েছে। একমাস আগের ঘটনা হলেও এখনো এ নিয়ে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেই। অভিযুক্ত স্বপদে বহাল থেকে অফিস করছেন। বিষয়টি নিয়ে ভেতরে ভেতরে তোলপাড় চলছে। অধিকাংশ কর্মকর্তা বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ। নারীকর্মীরা উদ্বিগ্ন।
নিরাপত্তা শঙ্কায় বিএডিসির নারী কর্মকর্তারা
আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে ওঠা যৌন হয়রানির অভিযোগ সুষ্ঠুভাবে তদন্তের দাবি জানিয়েছেন বিএডিসির উইমেনস অ্যাসোসিয়েশন। গত ৬ মার্চ ১৭ জন নারী কর্মকর্তার সইসহ একটি লিখিত আবেদন করেছে সংগঠনটি।
আবেদনে নারী কর্মকর্তারা লিখেছেন, সম্প্রতি বিএডিসিতে একজন সাতমাসের অন্তঃসত্ত্বা নারী কর্মচারী তার সরাসরি নিয়ন্ত্রণকারী পুরুষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ লিখিতভাবে চেয়ারম্যানের কাছে দাখিল করেছেন। বিষয়টি নিয়ে কৃষি ভবনের তথা সমগ্র বিএডিসির নারী কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা উদ্বিগ্ন ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
সেখানে আরও বলা হয়, ওই কর্মকর্তা (আবুল কালাম আজাদ) এবং নারী কর্মচারীর একটি অডিও ফোনালাপ বিএডিসিতে মোবাইলের মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, যা শুনে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, পুরুষ কর্মকর্তা অপরাধ সংঘটিত করে নারী কর্মচারীর কাছে বারবার ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। অভিযুক্ত যুগ্ম-পরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তা ভুক্তভোগী কর্মকর্তাকে (তার সহকারী ব্যক্তিগত কর্মকর্তা) তাদের মধ্যে ভাই-বোনের সম্পর্ক তৈরি করার আকুতি জানান। বিএডিসির উইমেনস অ্যাসোসিয়েশন বিষয়টি নিয়ে অত্যন্ত বিব্রত।
বিএডিসির নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ ঘটনা ও ফোনালাপের বিষয়টি তদন্তের মাধ্যমে সত্য উদঘাটন করে সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করে অফিসে কর্মপরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য নারী অ্যাসোসিয়েশনের দ্বারস্থ হচ্ছেন।
বিএডিসি উইমেনস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মেরিনা সারমীন বলেন, ‘ঘটনাটি নিয়ে আমরা বিব্রত। সবাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অনেক নারীকর্মী আমাদের এটা নিয়ে বলেছেন। আমরা চেয়েছি, যাতে এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হয়ে সত্যটা কী, তা বের করা আনা হয়। চেয়ারম্যান স্যার আমাদের আশ্বস্ত করেছেন।’
দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন চায় কৃষি মন্ত্রণালয়
বিএডিসি কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়ও। গত ১০ মার্চ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. জসিম উদ্দিনের সই করা চিঠিতে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়। চিঠির সঙ্গে ভুক্তভোগীর লিখিত অভিযোগপত্রও যুক্ত করা হয়েছে। ওই চিঠিতে বলা হয়, বিএডিসির নিয়োগ ও কল্যাণ বিভাগের যুগ্ম-পরিচালক এবং পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন জরুরিভিত্তিতে কৃষি মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
হয়রানির অভিযোগ, ফোনকলে আপসের প্রস্তাব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘অভিযোগ নিয়ে কিছু বলতে চাই না। কেন তিনি এ অভিযোগ করেছেন, সেটা বুঝতে পারছি না। যিনি অভিযোগ করেছেন, তার সম্পর্কেও কিছু বলতে চাই না। এখানে বিভিন্নজন বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করছেন। তারা হয়তো আমাকে এখান (পরিকল্পনা বিভাগের প্রধানের পদ) থেকে সরাতে চাইছেন।’
তবে ভুক্তভোগীর সঙ্গে ফোনে কথপোকথন ছড়িয়ে পড়া রেকর্ডের সত্যতা স্বীকার করেন এই কর্মকর্তা।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিএডিসির চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ সাজ্জাদ বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। উইমেনস অ্যাসোসিয়েশনের আবেদনও পেয়েছি। ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত শেষে প্রতিবেদন পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বিএডিসি গঠিত এক সদস্যের তদন্ত কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মজিবর রহমান (সদস্য পরিচালক ক্ষুদ্রসেচ) জানান, অভিযোগের তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
‘নির্বাচনে হেরে পুলিশের গাড়িতে হামলা, বিজয়ী চেয়ারম্যান আটক’
লক্ষ্মীপুরে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে হেরে পুলিশের গাড়িতে হামলা চালিয়েছে পরাজিত......বিস্তারিত