TadantaChitra.Com | logo

১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সাংবাদিকতা পেশার বর্তমান বাস্তবতা

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৫, ২০১৯, ১৮:০৭

সাংবাদিকতা পেশার বর্তমান বাস্তবতা

“মুনজুরুল করিম”

সাংবাদিকতা পেশায় যারা কাজ করেন, তাদের নিয়ে বেশ কিছু গল্প প্রচলিত আছে। এই লেখার বিভিন্ন পর্যায়ে সেসব গল্প বলতে চাই। তবে, অনেকগুলো বছর ধরে যেহেতু আমি টেলিভিশন সাংবাদিকতার সাথে জড়িত- তাই এ লেখায় টেলিভিশন সাংবাদিকতা পেশার বাস্তবতায় বেশি গুরুত্ব পাবে।

গত ২৩ অক্টোবর সন্ধ্যায়, এক সাবেক সহকর্মী এলেন আমার সাথে দেখা করতে। এই অক্টোবর মাসের শুরুতে সর্বশেষ কর্মস্থলে চাকরি হারিয়েছেন তিনি। বাজারে কোন চাকরির সুযোগ নেই বললেই চলে, এখন কি করা যায়? এটাই হলো কথা বা গল্পের মূল বিষয়। প্রায় ১ যুগ টেলিভিশন সাংবাদিকতা করে তিনি কোন অবস্থায় পৌঁছেছেন, তার মুখেই শুনুন-
বাসায় এখনো জানে না যে, আমার চাকরি নেই। প্রতিদিন ঠিক সময়ে বাসা থেকে রেডি হয়ে বের হই। পুরো পরিবার আমার উপার্জনেই চলে বলা যায়। এখন যদি বলি যে, আমার চাকরি নাই তাহলে সবাই খুব ভেঙ্গে পড়বে।

কথা হলো- এতদিন ধরে শুধু চাকরিই তো করেননি তিনি, অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছেন। সেই অভিজ্ঞতার মূল্য কি দাঁড়ালো? কোথায় একটা পদে চাকরি করবেন তা নয়, শুধু একটা চাকরি পাওয়া নিয়েই শঙ্কা। এটা কিন্তু শুধু একজনের বাস্তবতা নয়। পুরো টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রির বাস্তবতা। এক সময়ের সবচেয়ে লোভনীয় চাকরির কি দশা, তা বুঝতে একটা ছোট হিসাব নিকাশ দেখুন-

আজই এই লেখাটা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এই ধস কিন্তু আজ শুরু হয়নি। মান-সম্মান রক্ষার জন্য মানুষের আলাদা যে পকেট থাকে, সেখানে লুকানো ছিল। কিন্তু এখন সেটা রক্ষা করাও কঠিন হয়ে গেছে তাই পকেটে আর থাকছে না। ২০০৬/০৭ এর দিকে শুনেছিলাম- মিডিয়ার ভাত একবার যার পেটে যায়, সে আর অন্য কোন চাকরি করতে পারে না। কেন?
কারণ, সাংবাদিকতা পেশাটা একটু অন্যরকম। অফিসের ভেতরে বা বাইরে খুব বেশি মানুষকে ‘স্যার’ বলার প্রয়োজন হয় না। আর দীর্ঘদিন এই পেশায় থাকলে এক ধরণের স্বাধীনচেতা মনোভাব তৈরি হয়। তাই অন্য কোন পেশায় গিয়ে, একজন সাংবাদিকের জন্য মানিয়ে নেয়া কষ্টকর হয়ে যায়। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে এ অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে।

অবস্থা বেগতিক দেখে অনেক সাংবাদিক বিদেশে চলে গেছেন, অনেকেই মাঠ পর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জনসংযোগ পেশায় চলে গেছেন। আবার কেউ ব্যবসা করার চেষ্টা করছেন। তবে সাংবাদিকের জন্য ব্যবসায়ী হওয়াটা খুব কঠিন কাজ।

সকল রূঢ় বাস্তবতা জেনেও যারা এখনো সাংবাদিকতায় আছেন, তারা এখন অনেক কঠিনের মুখোমুখি। কয়েকদিন আগে, এক গণমাধ্যম অফিসে একজন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। এখনো চিকিৎসা চলছে। পরে নাকি সে তার ঘনিষ্ঠ একজনকে বলেছেন- বেতন নিয়মিত না হওয়ার কারণে, তিন মাস হলো বাড়ি ভাড়া ঠিক মতো দিতে পারেননি। প্রতি মাসেই বাড়িওয়ালা টাকার জন্য চাপ দেন। এই টেনশন তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। তারপরই মানসিক চাপে এমন অবস্থা হয়েছে। এবার মনে করুন, একজনেরই যদি এমন অবস্থা হয় তাহলে আরো অনেকের কি অবস্থা! চাকরিজীবিরা সর্বতোভাবে তাদের বেতনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এক মাসে বেতন পেতে দেরি হলে বাড়ি ভাড়া, সন্তানের স্কুল, জরুরী চিকিৎসা, বাসার বাজার- সবকিছুই ওলট পালট হয়ে যায়।

এখণ কথা হলো- এত গ্ল্যামারাস একটা পেশা বা মাধ্যম এমন অবস্থায় গেলো কিভাবে?

এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেয়া সম্ভব নয়। বছরের পর বছর তুমুল প্রতিযোগিতা আর সোনালী দিন পার করেছে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। একটা সময় যোগ্য ব্যক্তিদের তাদের বেতনের দ্বিগুণ দিয়ে ডেকে নিতো অন্য চ্যানেলগুলো। সবশেষ, ২০১১ সাল পর্যন্ত এমন অবস্থা চলেছে। তারপর থেকে অভিজ্ঞতার চেয়ে স্বল্প খরচে তারুণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। বিজ্ঞাপনের বাজার খুব বেশি প্রসারিত না হলেও. টেলিভিশনের সংখ্যা ডজন ডজন বেড়ে যায়। এই রূপালী পেশায় ঢুকে পড়ে অসংখ্য তরুণ। স্মার্টনেস থেকে শুরু করে নিজের পরিচয় তৈরি করা- কত স্বপ্ন তাদের। কিন্তু ততদিনে এর তলা ফুটো হতে শুরু করেছে।

এই প্রক্রিয়াকে আরো ত্বরান্বিত করে সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যম- ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদি। বিনোদন বা খবরের জন্য টেলিভিশনের চেয়ে হাতের মুঠোয় থাকা মোবাইল ফোনকেই বেছে নেয় মানুষ। টেলিভিশন কেবল একটা সত্যিকার অর্থেই বোকাবাক্স হতে শুরু করে। এই পরিবর্তনের সাথে শুধু বাংলাদেশের গণমাধ্যম নয়, পুরো দুনিয়ার কোন গণমাধ্যমই টক্কর দিয়ে টিকে থাকতে পারেনি। অথবা বলা যায়, প্রচলিত গণমাধ্যম তাদের অহংকার টিকিয়ে রাখতে গিয়ে নিচের দিকে পড়তে শুরু করেছে।

আপনি বাংলাদেশের এমন কোন টেলিভিশন চ্যানেল পাবেন না যাদের টিভির পর্দায় প্রতিদিন একটি করে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। খুব বেশি হলে সপ্তাহে বা পনেরো দিনে একটু বা দুটি ভালো/দর্শকের পছন্দের অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। তাহলে দর্শক ঐ নির্দিষ্ট দিন বাদে বাঁকি দিনগুলো কেন ঐ চ্যানেল দেখবে? এই প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে প্রতিযোগিতা হয়েছে, কে কত জায়গা থেকে লাইভ প্রচার করতে পারে সেটা নিয়ে। কিন্তু কথা হলো- এই লাইভ অনুষ্ঠান প্রচার করার যতই সক্ষমতা থাকুক, বেশিদিন কার্যকর হয়নি। কারণ, যার হাতে স্মার্ট মোবাইল ফোন আছে সে-ই তো যে কোন ঘটনার লাইভ প্রচার করে দেয় সবার আগে।

প্রচলিত গণমাধ্যমের পতনের আরেকটি কারণ সরাসরি ফেসবুক। একটা টেলিভিশন চ্যানেল বা একটা পত্রিকার সাংবাদিক চাইলেই যে কোন খবর প্রচার করতে পারে না। প্রথমত: তাকে ঘটনা জানতে হয়, ঘটনাস্থলে উপস্থিত হতে হয়, তথ্য যাচাই-বাছাই করতে হয়। তারপর একটা সম্পাদনা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে গিয়ে তা খবর হিসেবে দর্শকের বা পাঠকের সামনে উপস্থাপিত হয়। কিন্তু ততক্ষণে ফেসবুকে প্রত্যেক ব্যক্তিই সাংবাদিক হয়ে ওঠে। এরপর যখন টেলিভিশন বা পত্রিকার সংবাদটা পরিবেশিত হয় তখন তা অনেকটাই পুরনো হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়ায় মানুষ ফেসবুকের প্রাথমিক তথ্যে মনের মধ্যে আগেই এই বিশ্বাস তৈরি করে রাখে। পরবর্তীতে সাংবাদিকের দেয়া তথ্য যত সত্যই হোক, তা যদি তার বিশ্বাসের বাইরে চলে যায় তবে সাংবাদিককেই অবিশ্বাস করতে শুরু করে।

আচ্ছা, তাহলে এখন কি হবে? শুরুতেই বলি, একটা সময় সংবাদ উপস্থাপনা যারা করতেন তারাও ষ্টার হয়েছিলেন। কিন্তু এখন সেটা আর সম্ভব নয় (যদিও এখন অনেক স্মার্ট ও মেধাবী ছেলেমেয়েরা কাজ করে)। চাকরিতে প্রতি মুহুর্তের অনিশ্চয়তা থাকায়, মনে প্রাণে সাংবাদিকের সংখ্যা কমে যাবে।

সংবাদমাধ্যমগুলো সরকারের ভর্তুকির জন্য অপেক্ষা করবে (যদি দেয়)। আরো অনেক কিছু ঘটবে বা ঘটছে।
মিডিয়া এখন সারা দুনিয়ার Individual Content Creator দের কাছে চলে গেছে। টেলিভিশনে কাজ করা মানুষেরা বলতেই পারে যে, তারাই মূল ধারা। কিন্তু সেই অহংকার দিয়ে টিকে থাকা নিশ্চিত করা যাবে না। বরং সেই Individual Content Creator দের কাছে পরাজিত হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। কারণ, তারা বিশ্বাস করে Content is the KING. কিন্তু টেলিভিশনগুলো সেই কনটেন্ট এর দিকেই নজর দেয়নি। ফলে শূন্যস্থান অন্য মাধ্যম পূরণ করেছে।

সবশেষে সাংবাদিকদের নিয়ে একটা গল্প বলি-
এক সাংবাদিক সপরিবারে পাত্রী দেখতে গিয়েছে।
দুই পক্ষের মধ্যে অনেক কথাবার্তা হবার পর, মেয়েপক্ষ থেকে জিজ্ঞেস করা হলো-
‘ছেলে সাংবাদিক বুঝলাম। কিন্তু কি চাকরি করে?’
একটা সময় সাংবাদিক বলতেই মানুষ এমন একটা পেশার ব্যক্তিকে বুঝতো-
হাঁটতে হাঁটতে যার জুতার তলা খয়ে যায়।
বুক পকেটে কিছু কাগজ ও একটা কলম থাকে।
সেই কলমের কালি আবার জামায় ছড়িয়ে যায়।
পকেটে টাকা থাকে না।
গত ১০ বছরে সেই ইতিহাস পাল্টে গিয়েছিল। কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যে তা আবার ফিরে এসেছে।

লেখকঃ হেড অফ ইনভেস্টিগেশন
ইনডিপেন্ট টিভি.

২৫.১০.২০১৯

 


যোগাযোগ

বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যলয়

কাব্যকস সুপার মার্কেট, ৩ ডি কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫।

মোবাইলঃ ০১৬২২৬৪৯৬১২, ০১৬০০০১৪০৪০

মেইলঃ tadantachitra93@gmail.com, tchitranews@gmail.com

সামাজিক যোগাযোগ

Web Design & Developed By
A

তদন্ত চিত্র কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েব সাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি।