অনলাইন ডেস্কঃ বিশ্বজুড়েই চলছে মহামারি করোনাভাইরাসের তাণ্ডব। ইতোমধ্যে ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে প্রাণঘাতী করোনা। থমকে গেছে সবকিছু। অর্থনীতির চাকা বন্ধ হয়ে মহামন্দার মুখোমুখি পুরো বিশ্ব। বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও থাবা বসিয়েছে এই সর্বনাশা করোনা।
ভাইরাসটির কারণে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে অর্থনৈতিক ক্ষতি এড়ানো সম্ভব নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তবে তারা মনে করছেন, সঠিক পরিকল্পনায় এগোলে ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব। এজন্য মানবিক বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে উৎপাদনের চাকা সচল রেখে স্থানীয় চাহিদা অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মানুষের যেন ক্রয়ক্ষমতা থাকে এবং স্থানীয় উদ্যোক্তারা যেন দেউলিয়া না হয়ে যান সে ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে রাষ্ট্রকে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য আর্থিক ক্ষতি মোকাবেলার পরিকল্পনা এখন থেকেই শুরু করতে হবে। বাংলাদেশ এখন বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পক্ষে চাহিদা সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। ফলে রফতানিতে আঘাত আসবেই। এ পরিস্থিতিতে স্থানীয় চাহিদার ওপর নির্ভর করে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হবে।
তারা বলছেন, রফতানিমুখী শিল্পের পাশাপাশি স্থানীয় শিল্পের জন্য প্রণোদনা দিতে হবে। তবে সেই প্রণোদনা কোনো দান-খয়রাত হবে না। স্বল্প সুদে ঋণ সহায়তার আকারে এই প্রণোদনা দিতে হবে। সেই সঙ্গে ভিজিডি এবং ভিজিএফ কর্মসূচির আওতা বাড়িয়ে কর্মহীন মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাসের আর্থিক ক্ষতি মোকাবেলার পরিকল্পনা এখন থেকেই শুরু করা উচিত। তবে আমাদের এটা বুঝতে হবে যে, আমরা ক্ষতি কিছুটা লাঘব করতে পারব, কিন্তু এটা পুরোপুরি পোষানো সম্ভব নয়। কারণ আমরা এখন বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিশ্ব অর্থনীতি পরিস্থিতির ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তার ফলে আমাদের রফতানি ও রেমিট্যান্স ব্যাহত হবে।
তিনি বলেন, এখন সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে মানবিক দিকটাকে দেখা। আমাদের প্রবৃদ্ধি কী হোক বা না হোক, সেটা নিয়ে এতো মাথা ঘামানোর দরকার নেই। যেসব ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাদের মানবিক সহায়তা দিতে হবে। অনানুষ্ঠানিক খাতে যারা কাজ করে তারা এখন কাজ পাচ্ছেন না, তাদের ত্রাণ সহায়তা দিতে হবে। মানবিক দিকটা এই মুহূর্তে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া উচিত।
বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেন, রফতানি দু’টি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। একটা হলো দেশীয় উৎপাদন ক্ষমতা। আর দ্বিতীয়টি হলো- বৈশ্বিক চাহিদা। বৈশ্বিক চাহিদার বিষয়টি তো আমাদের হাতে নেই। বিশ্বে চাহিদা অবশ্যই কমবে এবং ইতোমধ্যে কমেছে। এখন দেশের উৎপাদন ক্ষমতা আমাদের ধরে রাখার চেষ্টা করতে হবে। তবে শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়েও পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। যাতে তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত না হয়।
তিনি আরও বলেন, কৃষি খাতে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। এখন জিডিপিতে মূল কৃষিখাতের অবদান ১৫-১৬ শতাংশ। খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কৃষির ভূমিকা অপরিহার্য। সুতরাং কৃষির উৎপাদন যেন ব্যাহত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, করোনা ভাইরাসের অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবেলায় আমাদের তাৎক্ষণিক, স্বল্পমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নিতে হবে। তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের মধ্যে হতে পারে- যাদের খাদ্য নেই, তাদের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য যে কোনো মূল্যে তাদের কাছে খাবার অথবা টাকা পৌঁছাতে হবে। এটা সরকারও করতে পারে, বেসরকারি উদ্যোগেও হতে পারে। এমনকি ব্যক্তিগতভাবেও করা যেতে পারে।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, স্বল্পমেয়াদে এসএমই খাতের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে। গার্মেন্টেসের জন্য সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, সেটা খুব ভালো। কিন্তু একই রকম শিল্প তো আরও রয়েছে, তাদের কী হবে? হোটেল, পর্যটন, এভিয়েশন- সব খাত বসে গেছে। এদের বাঁচানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। আরএমজির জন্য যেমন সরকার প্যাকেজ করছে, এসএমই’র জন্যও তেমন প্যাকেজ করতে হবে।
আতিউর রহমান বলেন, আমাদের কৃষি যদি বাঁচে, তাহলে আমরা করোনাভাইরাসের ফলে সৃষ্ট সংকট থেকে বাঁচতে পারব। আমি যদি নিজের খাবার নিজে তৈরি করতে পারি তাহলে বাইরে থেকে আনার কষ্ট থাকবে না। সুতরাং কৃষককে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
এখন কৃষকের সমস্যা হয়ে গেছে- তারা উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারছেন না। ডিম বিক্রি করা যাচ্ছে না। গরুর খামারির দুধ বিক্রি হচ্ছে না। সুতরাং এই সাপ্লাই চেন কিভাবে সক্রিয় করা যায় তার পদক্ষেপ নিতে হবে। ট্রাকচালকসহ সকলকে যথেষ্ট সুরক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে মার্কেটিং ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে। দুধ যদি ফেলে দিতে হয় তাহলে এটা আমাদের জন্য বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। দুধ সংগ্রহ করে বিক্রি করা না গেলেও পাউডার করার ব্যবস্থা করতে হবে। পাউডার করে আগামী দিনের জন্য রেখে দেয়া যেতে পারে। এটা সরকারও করতে পারে আবার বেসরকারি উদ্যোগেও করা যায়- বলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর।
দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের বাজেটকে পুনর্বিন্যাস করতে হবে। করোনায় যেসব খাত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, সেইসব খাতে বেশি খরচ করতে হবে। যেমন- সারাজীবন স্বাস্থ্য খাতে যে পরিমাণ অর্থ দেয়ার কথা আমরা তা দেইনি। স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়াতেই হবে।
তিনি আরও বলেন, বোরো শস্য যাতে কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। কৃষক যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য সরকার কৃষকদের সঙ্গে শস্য কেনার চুক্তি করতে পারে। এক্ষেত্রে একটি দাম নির্ধারণ করে সরকার কৃষকের সঙ্গে ধান কেনার চুক্তি করবে এবং ধানের অর্ধেক দাম ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে সরকার আগেই কৃষককে দিয়ে দেবে। যাতে করে কৃষক বাঁচতে পারে। এ ধরনের নতুন নতুন ভাবনা আমাদের ভাবতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) অনারারি ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, করোনার প্রভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবেলায় আর্থিক খাতভিত্তিক এবং রাজস্ব ও মুদ্রানীতির মাধ্যমে পদক্ষেপ নিতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের জিডিপিতে স্থানীয় বাজারের অবদান অনেক বেশি। সেটাকে আমাদের চাঙ্গা রাখতে হবে। যদি বৈশ্বিক বাজারে অনেক মন্দা হয় এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা দীর্ঘ সময়ের জন্য এমন বিচ্ছিন্ন থাকে, তাহলে আমাদের স্থানীয় চাহিদার ওপর নির্ভর করেই অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হবে। এটাই আমাদের অর্থনীতির মূল শক্তি। সেজন্য স্থানীয় চহিদাকে যেন আমরা অব্যাহত রাখতে পারি, মানুষের যেন ক্রয়ক্ষমতা থাকে, উদ্যোক্তারা যেন দেউলিয়া না হয়ে যান, সে ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলো যেন টিকে থাকতে পারে, সে জন্য তাদের স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সম্ভব হলে ২ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে হবে, তা না হলে ৫ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে একদিকে যেমন তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটানো যাবে, অন্যদিকে এই দুর্যোগ কেটে গেলে তারা আবার সচল হওয়ার সুযোগ পাবেন। সুতরাং আমাদের চাহিদা সচল রাখতে হবে এবং সরবরাহ ক্ষমতাও অব্যাহত রাখতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা দেখছি যে একটি সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তার মাধ্যমে তারল্য সরবরাহ বৃদ্ধি করার বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। ঋণ প্রবাহ ঠিক রাখতে এবং স্বল্প সুদে উদ্যোক্তাদের ঋণ দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা আরও বাড়ানো যেতে পারে। ইতোমধ্যে এসএলআর কমানো হয়েছে, যেটাকে আরও রিভিউ করা যেতে পারে। রফতানিমুখী শিল্পের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার যে তহবিল করা হয়েছে, আমি মনে করি স্থানীয় শিল্পের জন্য এ ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। যাতে করে তারা শ্রমিকদের বেতন দিতে পারেন। তারা যাতে দেউলিয়া হয়ে না যান, তার জন্য চেষ্টা করতে হবে।
সিপিডির এই ফেলো বলেন, অনেক শ্রমিক গ্রামে চলে গেছেন। সেখানে আমাদের যে ভিজিডি এবং ভিজিএফ কার্যক্রম আছে তার আওতা আরও বাড়াতে হবে। খোলা বাজারে বিক্রির পরিধি আরও বাড়াতে হবে। তাহলে যেসব উদ্যোক্তা এখন মজুরি দিতে পারছেন না, তারা হয়তো পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দিতে পারবেন।
তিনি বলেন, সামনে বাজেট আসছে। এ বাজেটে অগ্রাধিকার খাতগুলোকে পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। করোনাভাইরাসের আগে আমাদের যে বার্ষিক কর্মসূচি নির্ধারণ করা হয়েছে, তা আরেকবার পর্যালোচনা করে অগ্রাধিকার খাতগুলো ঠিক করতে হবে এবং ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেট সেভাবে সাজাতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সামগ্রিকভাবে সবগুলো খাত নিয়ে পর্যালোচনা করতে হবে। বেশ কিছু খাতে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ৬ কোটি ১০ লাখ মানুষ এখন আমাদের শ্রমবাজারে আছেন। তাদের মধ্যে এক কোটি ৪০ লাখ লোক মাসিক বেতন পান, তারা হয়তো সেটা পাবেন। কিন্তু এক কোটির মতো আছেন যারা দৈনিক মজুরির ওপর নির্ভর করেন এবং ২ কোটি ৭০ লাখের মতো আছেন যারা স্বকর্মের ওপর নির্ভর করেন। এদের কিন্তু রুটি-রুজি প্রায় বন্ধ। ভিজিডি এবং ভিজিএফসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারকে তাদের সহায়তা করতে হবে।
‘রাজশাহীতে আবাসন ব্যবসায়ী”র বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ব্যবসায়ীক ও যুবলীগ নেতা’
নিজস্ব প্রতিনিধি: আদালতে নির্দেশনা অমান্য করে জালিয়াতি মাধ্যমে জমি হাতিয়ে......বিস্তারিত