নিয়োগ দুর্নীতির আখড়া রেলে!

লেখক: সাব এডিটর
প্রকাশ: ৭ years ago

বাংলাদেশ রেলওয়ে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। প্রকল্পের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের পাশাপাশি প্রতিটা নিয়োগ পরীক্ষায়ও ঘুষের হাট বসে রেলে। আর রেলের ‘কালো বিড়াল’ সব সময় থেকে গেছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এতে অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘুষ বাণিজ্য ও লুটপাট সব সীমা ছাড়িয়েছে। জনসেবার এ দফতরটি দুর্নীতির কারণে জনভোগান্তির মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। কর্তৃপক্ষের অবহেলায় প্রায়ই ঘটছে ট্রেন দুর্ঘটনাও। প্রাণ হারাচ্ছেন সাধারণ যাত্রীরা। সব মিলিয়ে রেলওয়ে সেবার মান দিনে দিনে পতন হচ্ছে। আর রেলে নিয়োগ পাওয়া কর্তকর্তা-কর্মচারীরা চাকরি পাওয়ার অল্প দিনেই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছেন। এমনটাই জানা গেছে- সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে। রেলওয়ের বিভিন্ন সময়ে নিয়োগ পরীক্ষায় ঘুষ, প্রশ্নফাঁস, ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা গ্রহণ, নিয়োগের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা লঙ্ঘনের প্রমাণও পাওয়া গেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিভিন্ন সময়ে রেলের দুর্নীতি তদন্তে নেমে এসব প্রমাণ পায়। তারপরও রেলের ‘কালো বিড়াল’ নিরাপদেই রয়ে গেছে। দুর্নীতির দায়ে কখনোই কালো বিড়ালকে আইনের মুখোমুখি হতে হয়নি। ফলে দুর্নীতি আর হরিলুট কান্ডে ধুঁকছে রেল। রেলকে সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে ভিন্ন মন্ত্রণালয়ে রূপান্তর করার পর হরিলুটের মাত্রাও বাড়ে। বিশেষ করে নতুন মন্ত্রণালয় হওয়ার পর রেলকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর অংশ হিসেবে জনবল নিয়োগ হয় ব্যাপকহারে। সেই সুবাদে নিয়োগ বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ, দুর্নীতি, ঘুষ বাণিজ্য ও প্রশ্নফাঁসের মতো অনিয়মও হতে থাকে।
এটা সবাই জানেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মন্ত্রীত্ব হারিয়েছিলেন এই নিয়োগ দুর্নীতির কারণেই। কিন্তু, সুরঞ্জিত সেনের পরও নিয়োগ-দুর্নীতি থেমে থাকেনি। বর্তমান মন্ত্রীর আমলেও রেল মন্ত্রণালয়ে একের পর এক নিয়োগ কেলেঙ্কারি ফাঁস হচ্ছে। নিয়োগ-দুর্নীতিতে মন্ত্রীর দফতরও জড়িত রয়েছে। নানা অনিয়ম-দুর্নীতি আর মামলার কারণে বর্তমানে রেল বিভাগের বিভিন্ন পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত রয়েছে। কিন্তু, তারপরও থেমে নেই নানান কৌশলে তলে তলে মন্ত্রীর দতফতরের দুর্নীতিবাজরা নিয়োগ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
এএসএম নিয়োগে কোটি টাকার বাণিজ্য
২০১১ সালের ডিসেম্বরে রেলপথ মন্ত্রণালয় হয়। এর পর থেকে রেল বিভাগকে ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়ায় লোক নিয়োগের নতুন নতুন সুযোগ যেমন তৈরি হয়, তেমনি নিয়োগ-বাণিজ্যও এখানে বহুল আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সেই নিয়োগ কেলেঙ্কারি ছাড়াও বর্তমান মন্ত্রী মুজিবুল হকের সময়ে লোক নিয়োগে প্রত্যেকবারই ব্যাপক দুর্নীতি হয়। বিশেষ করে ২০১৬ সালের জুলাইয়ে সহকারী স্টেশন মাস্টার (এএসএম) পদে ২৫৭ জনের নিয়োগকে কেন্দ্র করে কেলেঙ্কারি কা- বেধে যায়। এই নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। নিয়োগ তালিকা প্রকাশের আগে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার প্রাপ্ত নম্বর সংবলিত টেবুলেশন শিট করা হয়নি। কোটা ব্যবস্থার অপপ্রয়োগ হয়েছে। এ নিয়ে নিয়োগ কমিটির কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি দুর্নীতিবাজচক্র ৮ থেকে ১০ কোটি টাকার বাণিজ্য করেছে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কোটা না মেনে ফেনী জেলায় তিনজনের স্থলে ছয়জন, রাজশাহী বিভাগে ৩৫ জনের কোটায় ৪০ জন ও খুলনা বিভাগে ৩২ জনের বিপরীতে ৩৩ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যদিও এ ব্যাপারে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. আবদুল হাই বলেন, ‘টেবুলেশন শিট তৈরি ছাড়া এবং রেজিস্টার না মেনে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। কোটাসহ সব কিছু মেনেই নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে।’
রেলওয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেধার ভিত্তিতে অর্ধশতাধিক নিয়োগ পেলেও বেশির ভাগ নিয়োগ হয়েছে মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে। নিয়োগ পেতে একেকজনকে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ লেনদেন করতে হয়েছে। লিখিত পরীক্ষায় অনেকে ভালো করলেও মোখিক পরীক্ষায় নম্বর কম দেওয়া হয়েছে। আবার লিখিত পরীক্ষায় খারাপ করলেও ঘুষ লেনদেনের মাধ্যমে মোখিক পরীক্ষায় অস্বাভাবিক নম্বর দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, ওই বছরের ৩০ জুন সহকারী স্টেশন মাস্টার পদে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত প্রার্থীর নামের তালিকা মেধাক্রমানুসারে প্রকাশ করা হয়। আহ্বায়ক মো. রোকনুজ্জামানসহ পাঁচ সদস্যের নিয়োগ কমিটির কর্মকর্তাদের স্বাক্ষরিত তালিকাটি প্রকাশ করা হয়েছে ঈদের ছুটির মধ্যে। ১০ জুলাই, ২০১৬ অফিস খোলার পর দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিয়োগপ্রাপ্তরা চট্টগ্রামের পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের সদর দফতরে গিয়ে চাকরিতে যোগদান করেন। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ২৯ অক্টোবর পূর্বাঞ্চল রেলের চিফ পার্সোনেল অফিসার অজয় কুমার পোদ্দার স্বাক্ষরিত ২৭০টি সহকারী স্টেশন মাস্টার পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। তৃতীয় শ্রেণির এই পদে নিয়োগ পেতে আবেদন জমা পড়ে প্রায় ৭০ হাজার। যাচাই-বাছাই শেষে ৬৮ হাজার জনকে লিখিত পরীক্ষার জন্য মনোনীত করা হয়। ২০১৬ সালের ৪ মার্চ লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন ৩৬ হাজার ৪১৩ জন। উত্তীর্ণ হন ৩ হাজার ৪২ জন। ওই পদের মধ্যে ঢাকা ও সিলেটের ১৩টি (কোটা) শূন্য থাকে। ৬০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর উত্তীর্ণদের ওই বছরের ২৫ এপ্রিল থেকে ৮ মে ৪০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার পর ২৫৭ জনকে ৩ জুলাই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এক প্রার্থী অভিযোগ করে বলেন, ‘লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় আমি খুব ভালো করেছিলাম। জানতাম পরীক্ষায় ভালো করলেও টাকাপয়সা ছাড়া চাকরি হবে না। শুনেছি অনেকেই ১০-১২ লাখ টাকা দিয়ে নিয়োগ পেয়েছেন। ফলাফল দেখার পর মনে হয়েছে টাকা না দেওয়ায় আমার চাকরি হয়নি।’
এদিকে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন পর্যন্ত মানা হয়নি। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী তৃতীয় শ্রেণির এ পদে নিয়োগ পরীক্ষায় লিখিত ৯০ এবং ভাইভায় ১০ নম্বরের পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও লিখিত ৬০ এবং ভাইভায় ৪০ নম্বরে পরীক্ষা নেয়া হয়। যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীকে প্রাধান্য না দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম মেধাসম্পন্ন প্রার্থীকে দলীয় বিবেচনা ও আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে নিয়োগ দেয়ার জন্যই এটা করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দেয়া ৮৫ জনের লিস্ট ছাড়াও নিয়োগ কমিটি ও রেলওয়ে কর্মকর্তাদের পছন্দের লোক নিয়োগ পেয়েছে।
জানা যায়, এই নিয়োগ বাণিজ্যের সঙ্গে রেলমন্ত্রীর পিএস, ব্যক্তিগত সহকারী আলম, জামাল ও মন্ত্রীর গাড়িচালক রিপন, পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক মো. আবদুল হাই, নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের এডিশনাল সিওপিএস মো. রোকেনুজ্জামান, রেলওয়ে শ্রমিক লীগের সভাপতি হুমায়ুন কবীর জড়িত। যদিও তারা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
এ বিষয়ে রেলপথমন্ত্রী মো. মুজিবুল হককে ওই সময় প্রশ্ন করা হলে তিনি অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘নিয়োগ নিয়ে কোনো দুর্নীতি সহ্য করা হবে না। যারা অভিযোগ তুলেছেন তারা আমাদের সামনে এসে বলুক। দূর থেকে বললে অভিযোগ আমলে নেয়ার সুযোগ নেই।’ মন্ত্রীর দফতর থেকে প্রার্থীদের লিস্ট দেয়া সম্পর্কে মুজিবুল হক বলেন, ‘অভিযোগকারীদের আমার, রেলওয়ে সচিব ও রেলওয়ে ডিজির সামনে এসে স্টেটমেন্ট দিতে হবে।’
তবে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক মো. মুকবুল আহম্মেদ বলেন, তিনি পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে জিএম থাকাকালীন সহকারী স্টেশন মাস্টার নিয়োগ পরীক্ষা সম্পন্ন করেন। তারপর তাকে তড়িঘড়ি করে ওই পদ থেকে সরিয়ে রেল ভবনে আনা হয়। তালিকা অনুযায়ী চাকরি দিতে না পারায় তাকে বদলি করা হয়।
বিগত নিয়োগ কমিটিগুলোর বেশ কয়েকজন আহ্বায়ক ও সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সব দফতরে জনপ্রশাসনের প্রজ্ঞাপন মেনে নিয়োগ সম্পন্ন করা হলেও রেলওয়েতে বিশেষ করে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির নিয়োগের বেলায় তা মানা হয় না।
এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘কোনো চাকরির ক্ষেত্রে তালিকা, ডিও লেটার কিংবা কোনো ধরনের তদবির গ্রহণযোগ্য নয়। তার ওপর কোনো নিয়োগ যদি জনপ্রশাসনের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী না হয়, তাহলে তো পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াটিই অবৈধ। এর আগেও রেলওয়েতে নিয়োগ নিয়ে ভয়াবহ দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। কোনো প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রেই যদি দুর্নীতি হয়, তবে সেই প্রতিষ্ঠান যে দুর্নীতিগ্রস্তদের আখড়া, তাতে সন্দেহ নেই।’
দুদকের তদন্তে দুর্নীতিপ্রমাণের পরও নিয়োগ বাতিল হয়নি
সুরঞ্জিতের সময়ের সেই আলোচিত রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের ছয় বিভাগে ১ হাজার ৬৯টি পদে নিয়োগে ব্যাপকহারে যে ঘুষ বাণিজ্য হয়েছে দুদকের তদন্তে অবশেষে তা প্রমাণিত হয়। রেলের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নকারীরাও এতে জড়িত।
রেলের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি চট্টগ্রামের একটি হাইস্কুলের ৯ জন এবং একটি কলেজের ৭ জন শিক্ষক এই কেলেঙ্কারিতে জড়িত বলে প্রমাণ পেয়েছে দুদকের তদন্ত দল। এই শিক্ষকেরা নিয়োগসংক্রান্ত মৌখিক পরীক্ষার পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষার খাতায়ও নম্বর বাড়িয়ে দিয়েছেন। রেলওয়ে ও মন্ত্রণালয়ের আলাদা তদন্ত এবং সর্বশেষ দুদকের অনুসন্ধানে নিয়োগে দুর্নীতির প্রমাণ মিললেও বিতর্কিত নিয়োগগুলো বাতিল হয়নি। নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মীরা চাকরি করে যাচ্ছেন।
দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, রেলওয়ের কর্মচারীদের জন্য সংরক্ষিত পদ, মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের সন্তানদের জন্য পদসহ মহিলা/অনগ্রসর জেলা/আনসার-ভিডিপি/উপজাতি/এতিম/ প্রতিবন্ধীসহ বিভিন্ন ধরনের কোটার ক্ষেত্রে কোনো নিয়মনীতি মানা হয়নি। শুধু ঘুষের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ২০১০ সালে এই নিয়োগ-প্রক্রিয়া শুরু হয়ে ২০১২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত চলে। দুদকের অনুসন্ধান চলাকালেও নিয়োগ দেওয়া হয় বলে রেল সূত্রে জানা যায়। ২৪টি শ্রেণিতে ১ হাজার ১৭৭ পদের বিপরীতে এক হাজার ১১৭ জন নিয়োগ পান। বরখাস্ত হওয়া রেলের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ইউসুফ আলী মৃধা ও রেল পুলিশের কমান্ড্যান্ট এনামুল হকসহ ৩৯ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে প্রতিবেদন জমা দেন অনুসন্ধান কর্মকর্তারা। দুদকের উপপরিচালক মো. আবু সাঈদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল এই অনুসন্ধান করে। দুদক পরে এ বিষয়ে মামলাও করে।
দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, পূর্বাঞ্চল রেলের নিয়োগে দুর্নীতির প্রাথমিক প্রমাণ ও তদন্তের ওপর ভিত্তি করে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা করা হয়। ইউসুফ আলী মৃধা ছাড়া অন্য যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়, তারা হলেন- নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক ও পূর্ব রেলওয়ের অতিরিক্ত যান্ত্রিক প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান এবং সদস্যসচিব ও জ্যেষ্ঠ ওয়েলফেয়ার কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়া। তবে তৎকালীন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে তদন্ত ও মামলা থেকে বাঁচিয়ে দেয়া হয়।
জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি দুদক কয়েকজন কর্মকর্তার সম্পদের হিসাবও নিয়েছে। তারা হলেন- পূর্বাঞ্চল রেলের নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক হাফিজুর রহমান চৌধুরী ও সদস্যসচিব গোলাম কিবরিয়া, রেল বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এসএম লিয়াকত আলী, মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার (চট্টগ্রাম সদর পূর্ব) এফএম মহিউদ্দিন ও আইন কর্মকর্তা আমান উল্লাহ, বরখাস্ত হওয়া জিএম ইউসুফ আলী মৃধা ও তার স্ত্রী, কমান্ড্যান্ট এনামুল হক ও তার স্ত্রী।
রেল সূত্র জানায়, ২৪টি শ্রেণির বাইরে ওই সময় আরও নিয়োগ দেওয়া হয় নিরাপত্তা প্রহরী পদে ৪০০, কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানার ১২০ খালাসি এবং ৪০ জন নিরীক্ষক ও সহকারী নিরীক্ষক। এ ক্ষেত্রেও অনিয়ম হয়েছে। অনিয়ম তদন্তে তখন ঊর্ধ্বতন তিন কর্মকর্তার সমন্বয়ে তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু সেই তদন্তের ফলাফল আর জানা যায়নি। একই বছর এপ্রিলে নিয়োগ বাণিজ্যের খবর প্রকাশের পর এ নিয়ে হইচইয়ের মুখে তিন শ্রেণির ১ হাজার ৫৭৩ জন নিয়োগের প্রক্রিয়াটি থেমে যায়। পরে মন্ত্রণালয় সময় বাড়ায়। এদিকে মামলার কারণে থেমে যায় আরও ১০টি শ্রেণির ৬২৬ জনের নিয়োগ-প্রক্রিয়া।
নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস
রেলওয়ের ট্রেড এপ্রেন্টিস পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনায় রেল বিভাগে তোলপাড় হয়। কিন্তু এর দীর্ঘ আট মাস পর ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে কর্তৃপক্ষ পরীক্ষার খাতা নীরিক্ষণের প্রক্রিয়া শুরু করে। সূত্রমতে, রেলওয়ের ট্রেড এপ্রেন্টিস পদে নিয়োগ পরীক্ষা ২০১৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষার আগের দিন ২৯ ডিসেম্বর রাতে ওই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার কারণে তা বাতিল করা হবে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক। কিন্তু পরে তা করা হয়নি। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, রেলওয়ের ট্রেড এপ্রেন্টিস পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় বিপাকে পড়ে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে একটি তদন্ত কমিটি করে গোপনে ওই কমিটির প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে ওই পরীক্ষা বাতিল না করে বিতর্কিতভাবে পরীক্ষার খাতা আট মাস পর নিরীক্ষণ শুরু করে নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক অজয় পোদ্দার। যদিও নিয়োগ কমিটির একাধিক কর্মকর্তা প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি স্বীকার করেছেন ইতিমধ্যে।
এই নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৬ সালের জুন মাসে। ট্রেড এপ্রেন্টিস পদে ১৮০ জনকে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। একই বছরের ৩০ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় এই পদের নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল; তবে পরীক্ষা শুরু হয়েছে নির্ধারিত সময়ের ৪০ মিনিট পর। পরীক্ষার দিন ৩০ ডিসেম্বর সকাল ৮টায় সাংবাদিকদের হাতেও পৌঁছে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন-উত্তরপত্রের কপি। হাতে লেখা প্রশ্ন ও উত্তরপত্রের কপি পাওয়া যায় চট্টগ্রাম স্টেশন রোডের বিভিন্ন ফটোকপির দোকানে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রশ্ন ও উত্তরপত্রের ফাঁস হওয়া কপি নিয়োগ কমিটির সভাপতি অজয় কুমার পোদ্দারের নিজ হাতে লেখা ছিল।
রেলওয়ের একটি সূত্র জানায়, প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি আগের দিন রাতে জিএম-এর মোবাইলে ফোন করে একজন অফিসার নিশ্চিত করেন। কিন্তু জিএম বিষয়টি নিশ্চিত হয়েও তাৎক্ষণিক প্রশ্ন পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত না নিয়ে ওই প্রশ্ন দিয়েই পরীক্ষা চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। একাধিক সূত্রে জানা যায়, নিয়োগ বাণিজ্য সিন্ডিকেটে ছিলো একাধিক সদস্য। অভিভাবকেরা বলেছেন, রেলওয়ের নিয়োগে এতো অনিয়ম থাকার পরও যথাযথ কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
সর্বশেষ নিয়োগ কেলেঙ্কারি
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আগের দিন গভীর রাতেই ফাঁস হয়েছে। ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রায় ৩৩ হাজার পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন। জানা গেছে, রেলের এ নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন আগের দিন ১৪ ডিসেম্বর রাত ৩টার দিকে বিভিন্ন স্থানে পাওয়া গেছে। হাতের লেখা এ প্রশ্নপত্র বিভিন্নভাবে ৫ হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকায় বিক্রিও হয়েছে।
এভাবে রেলওয়ের প্রতিটি নিয়োগ পরীক্ষায় ব্যাপক জাল-জালিয়াতি ও অনিয়ম হচ্ছে। কিন্তু দুর্নীতির সঙ্গে জড়িদের কারো কারো বিরুদ্ধে দুদকের মামলা হলেও কালো বিড়াল নিরাপদেই আছে। ফলে রেলেরও উন্নয়ন হচ্ছে না। বাড়তি ভাড়া গুনেও যাত্রীদের সেবার মান উল্টো কমেছে। লোকসানের হাত থেকে রেলকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। বরং রেলের পেছনে সরকার তথা জনগণের টাকার অপচয় হচ্ছে বলেই মনে করা হচ্ছে।

 

সংবাদটি শেয়ার করুন...