নিজস্ব প্রতিবেদক : এক সময় কিছুই ছিলো না। এখন ব্যবসা, বাড়ি-গাড়ি, জায়গা জমির অভাব নাই। দুবাই কিনেছেন বিলাসবহুল বাড়ি। সাবেক স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) মুজিবুর রহমান ফকিরের মৃত্যুর পর ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে উপ-নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায় এমপি নাজিম উদ্দিন আহমেদের।
উপ-নির্বাচনে নাজিম উদ্দিন আহমেদ এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর বেপরোয়া হয়ে উঠে তার ছোট ছেলে তানজীর আহমেদ রাজীব। নাজিম উদ্দিন এমপি হলেও গৌরীপুরের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে তার পুত্র রাজীব। এমপি পুত্র রাজীবের নানা বেপোরোয়া কর্মকাণ্ডের কারণে গৌরীপুরে এখন সে রাজপুত্র নামেই পরিচিত। এমপি পুত্র রাজীবের বেপোয়োরা নানা কর্মকাণ্ডের তিনটি বিশেষ পর্বে আজ থাকছে প্রথম পর্ব!
বর্তমানে চায়ের কাপ থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব, মোবাইল ফোনের কিবোর্ডে তুফান উঠানো এক টপিক ময়মনসিংহ ৩ গৌরীপুর আসনের এমপি নাজিম উদ্দিনের আপত্তিকর ভিডিও। গত কিছুদিনে লাইক শেয়ারে আপত্তিকর ভিডিওটি রীতিমতো ভাইরাল হয়ে উঠেছে।
ওই ভিডিওতে গৌরীপুর ৩ আসনের সংসদ সদস্য নাজিম উদ্দিন আহম্মেদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে এক নারীকে দেখা গেছে, যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব থেকে শুরু করে গণমাধ্যমসহ ময়মনসিংহের রাজনৈতিক অঙ্গনেও বইছে তুমুল আলোচনা-সমালোচনার ঝড়।
জানা গেছে, এমপি নাজিম চাকুরীর প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ এবং ভিডিও ধারণ করে প্রায় দুই বছর যাবত যৌন হয়রানি করেছে একই উপজেলার তৌহিদা আক্তার (৩২) নামের এক নারীকে। সম্প্রতি ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে জনসম্মুখে আসে এমপি নাজিমের অপকর্ম।
ভুক্তভোগী তৌহিদা আক্তারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চাকরীর প্রলোভন দেখিয়ে একাধিক বার ধর্ষণ, যৌন হয়রানির অভিযোগে মামলা করতে গেলে মামলা নেয়নি থানা পুলিশ। নেতাকর্মীদের কাছে বিচার দিয়েও কোন সুরহা মেলেনি। ধর্ষণের বিচার চেয়ে মামলা করতে যাওয়ায় তাকে পুড়িয়ে মারা চেষ্টাও করে এমপি পুত্র রাজীব ও তার ক্যাডার বাহিনীরা।
চাকরীর প্রলোভনে একাধিকবার ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির বিচার চাওয়ায় উল্টো তাকেই মিথ্যা আইসিটি মামলায় ফাঁসিয়ে জেল খাটিয়েছে এমপি পুত্র রাজীব। যার মামলা নং-৩৮ (০১)/২০২০। তিনি আরও জানান, ১০ থেকে ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে চুপ হয়ে যাওয়ার জন্যও নানা ভাবে হুমকি, ভয়ভীতি দেখাচ্ছে রাজীবের ক্যাডার বাহিনীরা ।
সর্বশেষ, গত ৯ নভেম্বর ময়মনসিংহ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা দায়ের করি। তবে এমপি ও তার পুত্র প্রভাবশালী হওয়ায় আমি বিচার পাচ্ছি না৷ তাদের ভয়ে আমি ঘরছাড়া। অন্য জায়গায় আমাকে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে। আমার তো সব শেষ করে দিলো এমপি নাজিম ও তার পুত্র রাজীব। এসব বলেছেন ভুক্তভোগী ওই নারী।
নাজিম উদ্দিন হচ্ছেন ‘পুতুল’। তার হয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন ছেলে রাজিব। এমপির ছেলে রাজিব টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে সংশ্লিষ্টতা, নিয়োগ বাণিজ্য, স্থানীয় নির্বাচনে ইউপি চেয়ারম্যান, দলীয় মনোনয়নসহ বিভিন্নভাবে বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের সুবিধা দিয়ে যাচ্ছেন। আর বিনিময়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা।
বিএনপির পুর্নবাসন খুলে ছাত্রদল-যুবদলের অনেক নেতাকে দলে পদ দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সম্প্রতি এক ছাত্রলীগ নেতার কাছ থেকে চার লাখ টাকার বিনিময়ে এমপিও ভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরী নিশ্চিত করে দিয়েছেন এমপি পুত্র রাজীব।
এমপি পুত্র রাজীবের একচেটিয়া প্রভাব কায়েমের কারণে গৌরীপুর আওয়ামী লীগেও দেখা দিয়েছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। রাজীবের বেপোরোয়া কর্মকাণ্ডের কারণে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগে। এক সময়ের আওয়ামী লীগের ঘাটি হিসেবে পরিচিত গৌরীপুরে এখন কয়েকটি গ্রুপিংয়ে বিভক্ত।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক দলটির প্রবীণ এক নেতা বলেন, এমপির হয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন তার ছেলে রাজীব। তার একচেটিয়া প্রভাবের কারণে গৌরীপুরে এখন রব ওঠেছে ‘ঘরে-বাইরে ডাবল এমপি, ট্রিপল এমপি ’। তাকে সবাই রাজপুত্র বলেই জানে। তার ভয়ে কেউই প্রতিবাদ বা মুখ খুলতে সাহস পায় না।
মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে গঠনতন্ত্র অমান্য করে বিবাহিত, ইউনিয়নের বাসিন্দাকে পৌর কমিটিতে অর্ন্তভুক্তি ও হত্যা মামলার আসামি দিয়ে ছাত্রলীগের উপজেলা ও পৌর শাখার দুটি কমিটি গঠন করেছিলেন এমপি পুত্র রাজীব। বর্তমানে এসব অভিযোগের কারণে গৌরীপুর উপজেলা ছাত্রলীগের কমিটি স্থগিত রয়েছে।
জানা গেছে, নিজের রাজত্ব কায়েম করার জন্য ওয়ার্ড থেকে শুরু করে ইউনিয়ন, উপজেলায় তার অনুসারীদের এমনকি বিএনপি জামাত শিবিরের লোকদের টাকার বিনিময়ে দলে পদ পাইয়ে দেন এমপি পুত্র রাজীব।
গোটা এলাকাজুড়ে তিনি এখন এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। তার বেপোরোয়া কর্মকাণ্ডের কারণে গৌরীপুরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। তার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে অসহায় উপজেলার নৌকা পাগল ভোটাররাও। আর চরম অস্বস্তিতে রয়েছে উপজেলা ও জেলা আওয়ামী লীগও।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, প্রায় ১৪ বছর পর ২০১৭ সালে গৌরীপুর উপজেলা যুবলীগের সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এমপি নাজিম তার ছেলে রাজীবকে উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা করতে না পারায় চক্রান্ত করে যুবলীগের সম্মেলন বানচাল করতে চেষ্টা করেন এমপি নাজিম ও তার পুত্র রাজীব। ঐ দিন গৌরীপুরে সম্মেলন মঞ্চ, ইউএনওর বাসভবন ও শহরের বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলার অভিযোগে পৌর এলাকায় এমপি নাজিমের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল করে যুবলীগ নেতাকর্মীরা। এ সময় তারা সাংসদের ছবি ও কুশপুত্তলিকা দাহ করে।
সম্প্রতি এমপি নাজিমের অশালীন ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার কিছুদিন পরেই (১৭ অক্টোবর) গৌরীপুর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান শুভ্রকে (৩৪) কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এমপি নাজিম উদ্দিনের আপত্তিকর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরালে শুভ্রর হাত থাকতে পারে বলে তাকে এমপি পুত্রের নির্দেশে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
জানা গেছে, এমপি পুত্রের নিয়ন্ত্রণ থেকে বাদ যায়নি স্কুল কলেজের ম্যানেজিং কমিটি গুলো। শ্যামগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় ও গৌরীপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজের সভাপতি এমপি নিজেই। তার বড় ছেলে তানভীর আহমেদ সজীব মাওহা উচ্চ বিদ্যালয় ও পুম্বাইল মাদ্রাসার সভাপতি। এমপির ছোট ছেলে রাজীব দুই স্কুল কমিটির সভাপতি ও রাজীবের বউ এক মাদ্রাসা কমিটির সভাপতি।
এক সময়ের কিছু না থাকা এমপি পুত্রের ভাগ্য চাকা খুলে যায় ২০১৬ সালে। উপ-নির্বাচনে এমপি নাজিম নির্বাচিত হওয়ার ৪ বছরের বেপোরোয়া জীবন-যাপন থেকে শুরু করে পিতার নাম ভাঙিয়ে একচেটিয়া প্রভাব খাটিয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন এমপি পুত্র রাজীব। বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য দুবাই কিনেছেন বাড়ি। এলাকায় মিল কারখানা ও পেট্রোল পাম্পের জন্যও জায়গা কিনেছেন। এই সবই করেছেন বেপোরোয়া জীবন যাপন ও গৌরীপুরে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েমের মাধ্যমে।
এই সব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চেয়ে এমপি পুত্র রাজীবের সাথে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। একটি ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তিনি কোন জবাব দেন নি।
চলবে…
আগামী দুই পর্বে আসছে…
১। কী হচ্ছে গৌরীপুরে?
২। ময়মনসিংহ -৩ গৌরীপুর আসনে ‘ঘরে বাইরে ডাবল এমপি’।
‘পদ্মায় গোসলে নেমে ৩ কিশোরের মৃত্যু’
রাজশাহীর পবা উপজেলায় পদ্মা নদীতে ডুবে তিন কিশোরের মৃত্যু হয়েছে।......বিস্তারিত