প্রিয়া আক্তারঃ রাজধানীতে মহাখালীর চাঞ্চল্যকর কাজী রাশেদ হত্যার প্রায় তিন বছর হতে চলেছে। হত্যাকাণ্ডের পরপরই ভিডিও ফুটেজ পেয়েছে পুলিশ। চিহ্নিত হয়েছে জড়িতরা। তারপরও ইউসুফ সরদার সোহেল ওরফে সুন্দরী সোহেলসহ মূল আসামিরা রয়েছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। উল্টো মামলা তুলে নিতে নানাভাবে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে আসামি ও তাদের লোকজন। এমনকি বাদীকে হত্যারও হুমকি দিয়েছে এই চক্র। এ অবস্থায় আতঙ্কে দিন কাটছে নিহত রাশেদের স্বজনদের। এসব ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়রি করা হলেও কোনো ফায়দা হচ্ছে না। উল্টো বেপরোয়া হয়ে উঠছে সোহেলের অনুসারীরা।
কাজী রাশেদকে গুলি করে হত্যা করেন সুন্দরী সোহেল। ২০১৮ সালের ১৫ই জুলাই ভোরে বনানী থানা এলাকার মহাখালী জিপি-গ ৩৩/১ নম্বর বাড়ির পেছনের গলি থেকে রাশেদের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই বাড়ির তৃতীয় তলায় রেইনবো নিউজের কার্যালয়। এটি সুন্দরী সোহেলের প্রতিষ্ঠান।
সিসি টিভির ফুটেজে দেখা গেছে, মহাখালী স্কুল রোডে কঙ্কাল ভবনের কেচি গেইট দিয়ে সুন্দরী ইউসুফ সরদার সোহেলের পিছু পিছু ঢুকছে রাশেদ, ফিরোজ, দিপু, হাসুসহ আরও এক যুবক। একপর্যায়ে এক এক করে তাদের বের হতে দেখা যায়। হত্যাকান্ডের পরপর ভবনের বাইরের লাইটগুলো বন্ধ করতে দেখা গেছে ভিডিওতে। তারপরও আলো ছিলো। কিছুক্ষণ পর ওই ভবন থেকে রাশেদের গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত লাশ টেনে ধরে বের করে চার জন। তাদের মধ্যে ছিলো জহির নামে একজন। জড়িতদের এভাবে চিহিৃত করা গেলেও তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। সুন্দরী সোহেলের কার্যালয়েই রাশেদকে হত্যা করে লাশ নিচে ফেলে দেয়া হয় বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান।
পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রাশেদকে হত্যার পরেই বিদেশে পালিয়ে যান সুন্দরী সোহেল। এখন বিদেশে থেকেই মহাখালীর অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রন করছেন তিনি। প্রশাসনের কর্মকর্তা ও উপর মহলের নেতাকর্মীদের সাথে করছেন নিয়মিত যোগাযোগ।
জানা গেছে, মহাখালীতে এখন সুন্দরী সোহেলের স্থানে সবকিছু নিয়ন্ত্রন করেন তার চাচা জাকির হোসেন সরদার এবং তার আরেক ঘনিষ্ঠলোক শহীদুল ইসলাম সুমন। বিদেশে থাকা সোহেলের সব নির্দেশনা বাস্তবায়ন ও অপরাধমূলক কর্মকান্ড চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা এখন তারাই পরিচালনা করছেন। প্রতিমাসে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে আত্মগোপনে থাকা সোহেলকে তার ভাগের টাকা পাঠান জাকির। যুবলীগের কেন্দ্রীয় অথবা স্থানীয় যেকোনো পোগ্রামে জাকির ও সুমনের উপস্থিতি লক্ষনীয়। তারা নিজেদের বনানী থানা যুবলীগ নেতা দাবি করেন।
বিদেশে আত্মগোপনে থাকলেও প্রতিটি দিবসে, উৎসবে কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ইউসুফ সরদার সোহেলের নামে যুবলীগের ব্যানারে পোষ্টার লাগছে দেয়ালে দেয়ালে, ব্যানার-ফেস্টুন ঝুলে পাড়া-মহলার অলিতে গলিতে ও সড়কের মোড়ে। সক্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ।
স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা মিশু অভিযোগ করেন, সোহেলরা যুবলীগ নেতা নিখিল ও ইসমাইল হোসেনের ঘনিষ্ঠলোক তাই তাকে গ্রেপ্তারে কোনো পদক্ষেপ নেই পুলিশের।
মহাখালীতে নিহত রাশেদের বাসায় কথা হয় তার স্বজনদের সঙ্গে। তারা জানান প্রকাশ্যে রাশেদের ভাই রাজীবকে হত্যা করার হুমকি দিয়েছে জাকির। এসময় রাজীবকে মারধরও করেছে। একইভাবে নিহত রাশেদের স্ত্রীকে মামলা তুলে নিতে প্রকাশ্যে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে সন্ত্রাসীরা। এসব ঘটনার পর আতঙ্কে রয়েছে এই পরিবার। রাশেদের ছয় বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে আতঙ্কে-উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে তার স্ত্রী মৌসুমীর। মৌসুমি জানান, কয়েক দিন আগে বিকালে বাইরে বের হয়েছিলেন তিনি। সরকারি তিতুমীর কলেজের সামনে অচেনা এক যুবক তাকে হুমকি দিয়ে বলেছে, মামলা তুলে নিবি, নইলে স্বামীর মতো তোকেও মেরে ফেলবো। মৌসুমি বলেন, এখন ঘর থেকে বের হতে ভয় পাই। হত্যাকান্ডের ভিডিও ফুটেজ পেয়েছে পুলিশ তবুও আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পারলো না। সুন্দরী সোহেল তার লোকজনকে আমাদের পেছনে লাগিয়ে রাখছে। তারা আমাদের অনুসরণ করে। মামলা তুলে নিতে হুমকি দেয়।
রাশেদের স্ত্রী মৌসুমি জানান, বনানী থানা যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক ছিল সোহেল। দলীয় প্রভাব খাটিয়ে একের পর এক চাঁদাবাজি, হত্যাসহ নানা অপকর্ম করছে।
রাশেদ হত্যাকান্ডের পর যুবলীগ নেতা সোহেলের কার্যালয়ে অভিযান চালায় পুলিশ। সেখান থেকে দুটি বিদেশি পিস্তল, একটি বিদেশি রিভলবার, একটি শটগান ও ১২১টি গুলি জব্দ করা হয়। পুলিশ বলছে হত্যাকান্ডের পর সুন্দরী সোহেল দেশের বাইরে পালিয়ে গেছে। যে কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে এই হত্যাকান্ডে জড়িত অন্যান্যদেরও গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। হত্যাকান্ডের পর জাকিরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। হত্যাকান্ডের সময় কঙ্কাল ভবনের নিচে পাহারা দিয়েছিলো জাকির হোসেন সরদার। গ্রেপ্তারের পর আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দিয়েছে জাকির। এ মামলায় জাকির বর্তমানে জামিনে রয়েছেন।
জবানবন্দিতে জাকির বলেন, সোহেল ও ফিরোজ একটু দূরে ডেকে তাকে বলেন, ‘আজ রাশেদকে ফালাইয়া দিমু, তুই নিচে পাহারায় থাকিস। কেউ যেন ওপরে যেতে না পারে।’ রাশেদকে নিয়ে সোহেল, ফিরোজ, হাসু, দীপু ও আরও দু-তিনজন তৃতীয়তলায় সোহেলের অফিসে যায়। কয়েক মিনিট পর একাধিক গুলির শব্দ শুনতে পান জাকির। এর কিছুক্ষণ পর সোহেল ও অপরিচিত একজন নিচে নেমে এসে জাকিরের হাতে একটি ছোট বাক্স ধরিয়ে দিয়ে চলে যেতে বলে। এর কিছু সময় পর হাসু, দীপু, জহিরুল ও ফিরোজ রাশেদের গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত লাশ ধরাধরি করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামিয়ে এনে গেটের বাইরে দেয়ালের পাশে ফেলে দেয়। এ সময় তাদের হাতে পলিথিন জড়ানো ছিল। ৮ আগস্ট ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে এ জবানবন্দি দেন জাকির।
এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটি কিছুদিন বনানী থানা পুলিশ তদন্ত করে। পরবর্তীতে তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে হস্তান্তর করা হয়। মামলাটি তদন্ত করছে ডিবি’র সিরিয়াস ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ইউনিট।
রাশেদ হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সিরিয়াস ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের (সেনসেশনাল মার্ডার টিম) পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, সোহেল বিদেশে পালিয়ে যাওয়ায় তাকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। মামলায় জাকির নামের এক আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তার চেষ্টা চলছে। গত ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। আদালতে দাখিল করা অভিযোগপত্রে (চার্জশিট, নম্বর-২৬৬)। পরিদর্শক মনিরুজ্জামান জানান, রাশেদ হত্যাকান্ডে সুন্দরী সোহেলসহ কয়েক জনের সরাসরি সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মহাখালীর হকার্স মার্কেট ও ফুটপাতের দোকান থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলে সোহেলের সহযোগীরা। মহাখালী এলাকার সাততলা ও কড়াইল বস্তি, বনানী বেদে বস্তি, গোডাউন বস্তিতে গ্যাস-বিদ্যুত পানির অবৈধ সংযোগ দিয়েছে সোহেলের লোকজন। বাসিন্দাদের তথ্য অনুযায়ী, একটি গ্যাসের চুলার জন্য মাসে ৫০০ টাকা, একটি বিদ্যুৎবাতির জন্য ২০০ টাকা হারে ও পানির জন্য ঘর প্রতি ৩০০ টাকা আদায় করা হয়। এ ছাড়া সোহেলের সহযোগীরা আমতলী, টিভিগেট, নাখালপাড়াসহ অন্যান্য এলাকায় ইয়াবা ব্যবসা করে। স্থানীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে টেন্ডারবাজির অভিযোগও রয়েছে সোহেলের বিরুদ্ধে। সোহেল সরকারদলীয় একজন শীর্ষ নেতার নাম ভাঙিয়ে চলেন বলে জানিয়েছে গোয়েন্দারা।
কড়াইল বস্তি, বনানী বেদে বস্তি ও গোডাউন বস্তিতে সোহেলের ক্যাশিয়ার জাকিরের ঘনিষ্ঠ সুমন। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির অবৈধ সংযোগের টাকা কালেকশন করেন কামাল, ফটিক, নাসির উদ্দিন ও বনানী থানা পুলিশের সোর্স শহীদ। তারা বস্তিতে জায়গা দখল, বিচারের নামে ফিটিং বানিজ্য ও মাদক ব্যবসা করেন জাকির ও সুমনের শেল্টারে।
জানা যায়, ২০১৬ সালে রিকশা ভাড়া নিয়ে বাকবিতন্ডার একপর্যায়ে রিকশাচালকের পায়ে গুলি করেছিলো সোহেল। ২০১৩ সালে যুবলীগ নেতা জাকিরকে গুলি করেছিলো। এরআগে একটি হত্যা করে বিএনপি সরকারের আমলে দক্ষিণ আফ্রিকায় চলে যায় সোহেল। পরে ২০০৯ আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসলে দেশে আসেন। প্রভাব থাকার কারণে প্রতিটি অপকর্ম করার পর পার পেয়ে যায়।
মহাখালীর স্কুল রোডের জিপি.গ-৩৩/১ নম্বর ভবনে (কঙ্কাল বাড়ি) বসে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতো সোহেল। ভবনটি সোহেলের টর্চার সেল হিসাবে পরিচিত ছিল।
‘পদ্মায় গোসলে নেমে ৩ কিশোরের মৃত্যু’
রাজশাহীর পবা উপজেলায় পদ্মা নদীতে ডুবে তিন কিশোরের মৃত্যু হয়েছে।......বিস্তারিত