প্রেসক্রিপশন বিড়ম্বনা লেখার পর ডাক্তার নিজেও বুঝে না!!

লেখক: সাব এডিটর
প্রকাশ: ৭ years ago

সাদমান রাফিদঃ হৃদরোগের জটিলতা নিয়ে রাজধানীর একজন নামকরা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন পঞ্চাশোর্ধ মোঃ নাজিমউদ্দিন। ওষুধ লেখার পাশাপাশি চিকিৎসক প্রেসক্রিপশনের নিচে লেখেন নো স্মোকিং। কিন্তু ইংরেজিতে অগোছালো ও বিশৃঙ্খলভাবে লেখা এই ছোট বাক্যটি এমনই দুর্ভেদ্য যে, নাজিম উদ্দিন তা বুঝতেই পারেন নি। রাজধানীর বেশকিছু ফার্মেসির বিক্রেতারাও এটিকে ওষুধ ভেবে ভুল করেন। বিভিন্ন এলাকার ওষুধ বিক্রেতারা ব্যবস্থাপত্র দেখে জানান, এ ধরনের ওষুধ তাদের কাছে নেই। শেষে রাজধানীর কলাবাগানে অবস্থিত একটি ফার্মেসির একজন ব্যবস্থাপক নাজিমউদ্দিনকে ভুলটি ধরিয়ে দেন। তিনি জানান, লেখাটি কোনো ওষুধ নয়, তাকে (নাজিমউদ্দিন) ওষুধ সেবনের পাশাপাশি ধূমপান না করার উপদেশ দেয়া হয়েছে ব্যবস্থাপত্রে। এ ধরনের বিভ্রান্তিকর ঘটনা শুধু নাজিমউদ্দিনের ক্ষেত্রেই ঘটছে না। দেশের লাখ লাখ মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ছুটে যান ডাক্তারের কাছে। চেম্বার থেকে বেরিয়ে অগণিত মানুষ বিপাকে পড়েন সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন বা ব্যবস্থাপত্র নিয়ে। তাদের অভিযোগ কিছুসংখ্যক ডাক্তার এমনভাবে ব্যবস্থাপত্র লেখেন যে, বেশির ভাগ লোকই তা বোঝেন না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ওষুধ কিনতে গিয়ে ব্যবস্থাপত্রে লেখার কিছুই বোঝেন না রোগী ও তাদের স্বজন এবং সংশ্লিষ্ট ওষুধ বিক্রেতারা। রাজধানীর মিরপুর, কলাবাগান, শাহবাগ, পল্টন এলাকার বিভিন্ন ফার্মেসির মালিক, ব্যবস্থাপক, বিক্রয়কর্মী, রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বললে তারা এ অভিযোগ করেন। দুর্ভোগ, বিড়ম্বনা ও বিভ্রান্তি থেকে বাঁচতে তাদের দাবি- হয় ¯পষ্ট অক্ষরে ব্যবস্থাপত্র লেখা হোক কিংবা উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রিন্ট পদ্ধতিতে ব্যবস্থাপত্র লেখা বাধ্যতামূলক করার দাবি জানান। কলাবাগান এলাকার লাজ ফার্মার মহাব্যবস্থাপক বলেন, কিছু ডাক্তারের লেখা এমনই কঠিন যে, বুঝতে খুবই অসুবিধা হয়। আমাদের ফার্মেসিতে দক্ষ ফার্মাসিস্ট রয়েছেন। অনেক সময় তারাও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের লেখা ধরতে পারেন না। তবে, কোনো ভুল ওষুধ যাতে রোগীদের দেয়া না হয় সেজন্য আমরা চেষ্টা করি। তিনি বলেন, দেশের কিছু চিকিৎসক এখন কম্পিউটারে কম্পোজ করে প্রেসক্রিপশন লিখছেন। এটা ভালো দিক। আমাদের দাবি কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে প্রেসক্রিপশন লেখা বাধ্যতামূলক করা হোক। তাতে রোগী, তাদের স্বজন ও ওষুধ বিক্রেতাদের বুঝতে সুবিধা হবে। বিড়ম্বনাও কমবে। শাহবাগ এলাকার নিউ পপুলার ফার্মেসির ব্যবস্থাপক বলেন, প্রেসক্রিপশনে হিজিবিজি লেখার কারণে আমাদের যেমন নানা বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হয়, তেমনি রোগীরাও অনেক সময় চোখের ওষুধ কানে আবার কানের ওষুধ চোখে ব্যবহার করেছেন এমন ঘটনাও ঘটেছে। বিশেষ করে স্বল্পশিক্ষিত ও বয়স্কদের বেলায় এ ধরনের সমস্যা বেশি হয়। তিনি বলেন, এমনও হয়েছে ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্রের লেখা বুঝতে না পেরে তা সংশোধনের জন্য সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের কাছে রোগী বা তার স্বজনকে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে, যে ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখেছেন তিনি নিজেও অনেক সময় তা ধরতে পারেন না, আসলে তিনি কি লিখেছেন। আমরা দীর্ঘদিন ধরেই স্পষ্ট ছাপার অক্ষরে প্রেসক্রিপশন লেখার দাবি জানিয়ে আসছি। কলাবাগান, শাহবাগসহ বিভিন্ন এলাকার ফার্মেসিতে ওষুধ কিনতে আসা একাধিক রোগী ও তাদের স্বজনরা বলেন, কিছু ডাক্তারের লেখা এমনই দুর্ভেদ্য যে, প্রেসক্রিপশন নিয়ে একটার পর একটা ওষুধের দোকানে ঘুরতে হয়। কেউই তা বোঝেন না। কাঠখড় পুড়িয়ে ওষুধ নিলেও অনেক সময় ভুলে সকালের ওষুধ দুপুরে এবং দুপুরের ওষুধ রাতে খাওয়া হয়। বেশকজন রোগী ও তাদের স্বজনরা বলেন, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে লাইন ধরে টিকিট কিনে আবারো লাইন ধরে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। পরে ওষুধ কিনতে গিয়ে প্রেসক্রিপশনে ডাক্তারের লেখা নিয়ে পড়তে হয় নতুন ঝামেলায়। কিছু প্রেসক্রিপশনের লেখা সংশোধন করতে গিয়েও পড়তে হয় নানা বিড়ম্বনায়। মিরপুর কাজীপাড়ার নূরজাহান ফার্মেসিতে ওষুধ কিনতে আসা পঞ্চাশোর্ধ কাজী গোলাম রওশন তাজ বলেন, অনেক দিন ধরেই ওষুধ খাচ্ছি। তাই হয়তো কিছুটা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিন্তু অন্য কাউকে দিয়ে ওষুধ আনতে পাঠালেই বিপত্তি বাধে। কলাবাগানের এশিয়ান ফার্মেসির স্বত্বাধিকারী জিয়াদ মো. সামির বলেন, রোগীর চাপ হয়তো বেশি থাকে, তাই এমন হয়। কিছু প্রেসক্রিপশন এমনভাবে লেখা হয় যে, অনেক সময় আমাদের ভুল হয়ে যায়। এ জন্য প্রেসক্রিপশন না বুঝলে ওষুধ নেই বলে দিই। তিনি বলেন, হাতে লেখা প্রেসক্রিপশন বন্ধ হওয়া দরকার। বিশ্বের অনেক দেশেই কম্পিউটারে টাইপ করা কাগজে ওষুধ লেখেন ডাক্তাররা। আমাদের দেশেও এরকম পদ্ধতি চালু করা উচিত। শাহবাগ এলাকার মেসার্স ঔষধালয় ফার্মেসির ব্যবস্থাপক বলেন, প্রেসক্রিপশনের দুর্ভেদ্য লেখার কারণে স্বল্প শিক্ষিত এবং বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে বেশি সমস্যা হয়। বিড়ম্বনা ও বিভ্রান্তি দূর করার জন্য ছাপার ¯পষ্ট অক্ষরে প্রেসক্রিপশন লেখা বাধ্যতামূলক করা উচিত। একই সঙ্গে রোগীদের প্রতি চিকিৎসকদের আন্তরিকতাও বাড়ানো উচিত। শাহবাগ এলাকার দুটি ওষুধ ফার্মেসির দুজন বিক্রয়কর্মী বলেন, বেশির ভাগ ডাক্তারের লেখাই আমরা ঠিকমতো পড়তে পারি না। কি ওষুধ লিখেছে তা বুঝি না। সেখানে গ্রাম বা মফস্বলের রোগী ও তাদের স্বজনরা কি বুঝবে? এব্যাপারে মনোবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. নাসরীন ওয়াদুদ বলেন, ডাক্তাররা জানে রোগী বা ফার্মেসির ওষুধ বিক্রেতারা তার লেখা পড়তে পারছেন না। কিন্তু তারপরও তারা প্রেসক্রিপশনের লেখাকে সহজবোধ্য করেন না। তাদের কাছে ভিজিটই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। তিনি বলেন- ব্যস্ততা বা রোগীর চাপ নয়, পুরোটাই দায়িত্বহীনতা ও দায়িত্বশীলতার বিষয়। একজন ডাক্তার ইচ্ছা করলেই প্রেসক্রিপশনের লেখাকে সহজবোধ্য করে তুলতে পারেন। দায়িত্বশীল হতে পারেন। তিনি আরো বলেন, প্রেসক্রিপশনে ¯পষ্ট ভাষায় ওষুধ লেখা কিংবা ক¤িপউটারে ক¤েপাজ করে ওষুধ লেখার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের (স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়/স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) মাধ্যমে অবশ্যই নির্দেশনা জারি করা উচিত। এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, অনেক চিকিৎসকই আছেন যাদের লেখা ¯পষ্ট নয়। যে কারণে স্বল্পশিক্ষিত রোগী কিংবা ফার্মেসির ওষুধ বিক্রেতাদের বুঝতে সমস্যা হয়। কখনও কখনও তাদের ভুলও হয়ে যায়। তিনি বলেন, চিকিৎসকরা বিভিন্ন উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেছেন, তাই তাদের হাতের লেখা খারাপ-এমন কিন্তু নয়। তারা ইচ্ছা করলেই রোগীদের স্বার্থে প্রেসক্রিপশনের লেখা ¯পষ্ট করতে পারেন। এ বিষয়ে চিকিৎসকদের নির্দেশনা দেয়া যেতে পারে উলে­খ করে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে চিকিৎসকদের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। ব্যস্ততাও থাকবে, কিন্তু প্রেসক্রিপশনের লেখা ¯পষ্ট হতে হবে। রোগীকে প্রেসক্রিপশনের ওষুধ ভালো করে বুঝিয়ে দিতে হবে। আমি নিজেও এটি করি। আর নিতান্তই যাদের হাতের লেখা খারাপ তারা ক¤িপউটারাজড পদ্ধতিতে প্রেসক্রিপশন লিখবেন।

সংবাদটি শেয়ার করুন...