ফ্রান্সে মুসলমানদের রমজান

লেখক: সাব এডিটর
প্রকাশ: ৮ years ago

জাহিদ হাসান খান রনিঃ ফ্রান্স সামুদ্রিক অঞ্চলে ঘেরা পশ্চিম ইউরোপের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ এ দেশটিতে মুসলিম বসবাসকারীর সংখ্যা শতকরা পাঁচ ভাগের কিছু বেশি। ধর্ম পালনে নানা বিষয়ে বিধিনিষেধ কিংবা বাধ্যবাধকতা থাকলেও রমজানে রোজা ও অন্যান্য ইবাদতে এখানকার মুসলমানরা কিছুটা নিরাপদ ও স্বাধীন। পবিত্র রমজানের আগমনে ফ্রান্স জনবসতির বিস্তৃতির মতোই প্যারিসের মুসলিম বসবাসস্থল ‘বারবিস’ এর এলাকাজুড়ে রোজার আমেজ ও পরিবেশ বিরাজ করে, যা আরব ও মুসলিম দেশগুলোর রমজানের চিত্র স্মরণ করিয়ে দেয়। একটি বিশাল লোকসমাগমে সব শ্রেণিপেশা ও বয়সের নারী-পুরুষ একত্রিত হন, যেখানে বিক্রেতারা মিষ্টান্ন ও রমজানের দ্রব্যসামগ্রী প্রদর্শন এবং বিক্রয় করে থাকেন। এছাড়াও মুসলিম নারীরা মাঝ সড়কে বিভিন্ন স্থানে সুস্বাদু ও সুঘ্রাণযুক্ত নানারকমের ইফতারির পসরা সাজিয়ে বসেন। অপরদিকে আরব ও মুসলিম ইউনিটির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ মাসের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নতুনভাবে ঢেলে সাজানো হয়।
প্যারিসের নিচু এলাকার ‘নানতি’ নামক শহরের গোশত বিতানগুলোয় হালাল ও তরতাজা গোশত সংগ্রহে বেশসংখ্যক ক্রেতা দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন। আহমদ নামে একজন ক্রেতা বলেন, ‘এ মাসে গোশতের মতো সুস্বাদু পণ্য সংগ্রহকারীদের সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বেড়ে যায়।’
দোকানগুলো ক্রেতাদের প্রয়োজনীয় সবকিছু যেমনÑ দুধ, শাবাকিয়াহর মতো একধরনের পিঠা ও ইফতারসামগ্রী প্রদর্শন করে থাকে। এছাড়াও মরক্কোর ‘হারিরি’ নামক একধরনের মজাদার ‘সুপ’ এবং তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া ও মরক্কোর প্রসিদ্ধ একধরনের সুস্বাদু ‘শুরবা’ বা ঝোলও বিক্রি ও প্রদর্শিত হয়।
স্বদেশের সুপরিচিত ভাবধারা ও রীতি অনুযায়ী ফ্রান্সের মুসলমানরা রমজানকে পালন করতে চেষ্টা করেন। তাই ইফতারের ভোজে তৈরীকৃত নানারকমের ইফতার চোখে পড়ে। নিজ দেশের মতো করে রমজানের ব্যয়ভার বহনে পরিবারগুলোয় তেমন কোনো সমস্যা হয় না। তবে মাতৃভূমির বিরাজমান রোজার পরিবেশের অনুপস্থিতির বিষয়টি এসব পরিবার নির্দ্বিধায় স্বীকার করছে।

রোজার পরিবেশ
রমজানে এখানে রোজার পরিবেশ বিদ্যমান থাকলেও দুঃখের বিষয় হলো, মুসলিম অধিবাসীরা এখানে আজানের আওয়াজ শুনতে পান না। আর ফ্রান্সে ব্যয় প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যায়; তবে এটি বিভিন্ন উপলক্ষে তৈরীকৃত সামগ্রী দিয়ে ইফতারের টেবিল সৌন্দর্যম-িত করতে বাধা হয় না। তাছাড়া এ সুন্দর উপস্থাপনে বিশেষ গুণ ও অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রয়োজন দেখা দেয়।
রাজনীতি বিষয়ে উচ্চশিক্ষাধারী সাহাম নামের এক মহিলা বলেন, ‘এ মাসে আমাদের জীবনের দৈনন্দিন বিষয়ে সৃষ্ট কর্তব্য পালন অব্যাহত থাকাকালে রোজার প্রথম দিকের দিনগুলো খুবই কঠিনভাবে পার হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘রোজায় দিনের বেলা সময় এখন বেশ লম্বা। তাছাড়া দৈনন্দিন কাজের ক্লান্তি তো আছেই। তবে তিনি রোজায় শারীরিক ক্লান্তি অনুভব করেন না।’ সাহাম বলেন, ‘আমি সৌভাগ্যশীলা যে, আমি পরিবারের সঙ্গে ইফতার করছি এবং আত্মিক খোরাক ফিরিয়ে আনতে এ মাসকে কাজে লাগাচ্ছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘মহিমান্বিত এ মাসটি আমাদের থেকে নেওয়ার তুলনায় অধিক পরিমাণে দিয়ে যায়।’

রমজানে মসজিদগুলোর চিত্র
ফ্রান্স মুসলিম ধর্মীয় পরিষদের সহকারী প্রধান ও ফ্রান্স মুসলিম সোসাইটির প্রধান আনোয়ার ইকবিবিশ ফ্রান্স ২৪ চ্যানেলে এক বিবৃতিতে বলেন, রমজানে ফ্রান্সের মসজিদগুলো মৌলিক দুটি দায়িত্ব পালন করে। একটি সামাজিক, অপরটি আধ্যাত্মিক। তিনি আরও বলেন, এ উপলক্ষে সমাজের সব স্তর ও বয়সের মুসলমানের মাঝে পারস্পরিক সাক্ষাতের সুযোগ তৈরি হয়, এমনকি উপস্থিতির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য আকারে ছাড়িয়ে যায়। এছাড়াও তারাবি আদায়ের নিমিত্তে মুসল্লিরা আগ্রহভরে আগমন করেন। তিনি আরও বলেন, এ ধরনের পরিবেশ মুসল্লিদের একই পরিবারে সম্পৃক্ত হওয়ার অনুভূতির বিষয়টি জাগ্রত করে এবং পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করে। একেকটি মসজিদ যেন সামাজিক ঐকতানের কেন্দ্র। পবিত্র রমজানে এসব মসজিদ কর্তৃপক্ষ এবং মানব দরদি ও মুসলিম ভ্রাতৃত্ব স্থাপনকারী প্রত্যেকেই এ মাসে অসহায়, দরিদ্র ও অভাবীদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। তিনি আরও বলেন, রোজা উপলক্ষে বেশকিছু মসজিদে ইফতারের আয়োজন করা হয় এবং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রোজাদার এতে একত্রে মিলিত হন। মসজিদে ইফতারের আয়োজনের জন্য অর্থ সঞ্চয় করা হয়। চাই সেটি সাধারণ মুসলমানদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে হোক, যেমনটি তারা তৈরীকৃত ইফতারি বিতরণ করে থাকেন, অথবা কিছু দানশীল ব্যক্তির আর্থিক অনুদান প্রদানের মাধ্যমে হোক। আর মসজিদগুলোও এসব অংশগ্রহণে কল্যাণ ফান্ড থেকে ব্যয় করে থাকে। মসজিদগুলো জাকাতের অর্থ গ্রহণ ও জমা করার মতো গুরুদায়িত্ব পালন করে, এমনকি এসব মসজিদ ঈদুল ফিতরে অভাবগ্রস্তদের সংখ্যা নির্ধারণপূর্বক জাকাতের অর্থ বণ্টনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। উল্লেখ্য, বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট মুহূর্তে সাহায্যপ্রার্থীদের সংখ্যা দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

রমজানে মুসলিম ধর্মীয় পরিষদের ভূমিকা
আনোয়ার বলেন, ফ্রান্স মুসলিম পরিষদ ও তাদের সহযোগী সংগঠন সাধারণ মুসল্লিদের ও প্রবাসী মুসলমানদের বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশনা প্রদান এবং তাদের কল্যাণীকাজে উদ্বুদ্ধকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যার একটি হলো চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল হয়ে মাসের শুরু ও শেষের তারিখ নির্ধারণের বিষয়। সাধারণ কিছু প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি দল, বিভিন্ন ধর্মের ব্যক্তি, মসজিদ এবং সাংস্কৃতিক ও সেবা সংঘের প্রতিনিধি দলের আয়োজনে ‘উন্মুক্ত ইফতার’ এর আয়োজনের বিষয়টি চোখে পড়ার মতো। এ অভিনব আয়োজন ইসলামের পঞ্চ খুঁটির একটি ‘রোজা’র ক্রিয়ার ব্যাপারে অবগতির বিষয়কে একটি ‘ধর্মীয় প্রকাশ’ হিসেবে উন্মোচিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন অঞ্চলের তৈরীকৃত খাবারের স্বাদ গ্রহণের সুযোগ তো থাকছেই। মূলত এসব কিছুই ইফতারে আনন্দ প্রকাশ ও একটি সুন্দর আনুষ্ঠানিকতার রূপ দান করে।

সংবাদটি শেয়ার করুন...

  • ফ্রান্সে মুসলমানদের রমজান