* দেশজুড়ে বিভিন্ন ব্যাংকে হাজার কোটি টাকা লেনদেন, * পুলিশের বেশকিছু অসাধু কর্মকর্তার রয়েছে সংশ্লিষ্টতা..!
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচারের ঘটনা থামছেই না। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক নজরদারি, নিয়মিত অভিযান পরিচালনা, নানা প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ব্যাংকিং লেনদেনে কড়াকড়ি আরোপ করেও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না হুন্ডি বাণিজ্য। দিন দিনই অর্থ পাচারের পরিমাণ ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। বরং বিদেশ গমন, চিকিৎসা ব্যয় মেটানো, ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা, বৈদেশিক কেনাকাটা থেকে শুরু করে জীবনযাত্রার নানা ক্ষেত্র এখন হুন্ডির সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে পড়েছে এই সিন্ডিকেট। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রা লেনদেন সহজীকরণ, ব্যাংকগুলোর নানা সেবামূলক ব্যবস্থাপনাও হুন্ডি বাণিজ্যকে রোধ করতে পারছে না।
নন-ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাচারের প্রধান উপায়ই হচ্ছে হুন্ডি। দেশে হুন্ডি ক্রমেই ব্যাপক হচ্ছে। এসব টাকা হুন্ডি ব্যবসায়ীরা সোনাসহ বিভিন্ন চোরাচালানে ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া ব্যবসায়ীরা আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিং করেও দেশ থেকে দেদার অর্থ পাচার করছেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের টাস্কফোর্সও অতীতে এমন অনেক ব্যবসায়ীর অর্থ পাচারের প্রমাণ পেয়েছে। দেশে মুদ্রা পাচারবিরোধী অনেক কঠোর আইন আছে। কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই বললেই চলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশসহ আরও কিছু সংস্থা এই মুদ্রা পাচার রোধে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু সাফল্য খুবই কম।
বিগত ৩০ বছরে রাষ্ট্রের অন্তত ছয়টি বাজেটের সমপরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে। লুটেরা চক্রের সদস্যরা হুন্ডির মাধ্যমেই এ অর্থ লুটে নিয়ে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর বা দুবাইয়ে সেকেন্ড হোম গড়ে তুলেছেন। অনেকেই ইউরোপের দেশে দেশে নাগরিকত্ব নিয়ে সেখানেই ফেঁদে বসেছেন শত শত কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য। লুটে নেওয়া অর্থ দেশের শিল্প-বাণিজ্যে ব্যবহার হলে ৮০ লক্ষাধিক বেকারের কর্মসংস্থান হতো।
ভিনদেশি প্রতারকদের সঙ্গে মিলেমিশে এদেশীয় সহযোগীরা দফায় দফায় নানা কায়দা-কৌশলে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আরেক চক্র সীমাহীন প্রতারণার বেড়াজালে লুটে নিয়েছে ব্যাংকগুলোর টাকা। একশ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী লাগামহীন দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় অর্থসম্পদ লুটপাট করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা সেসব টাকা নিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন ভিন্ন দেশে। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সরকারি আমলা সবাই সেকেন্ড হোম গড়ে তুলতে শত শত কোটি টাকা পাচার করেছেন বিদেশে। সবকিছুই ঘটেছে হুন্ডির মাধ্যমে, সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের হাতে।
মাদারীপুর থেকে আসা সফিউল আলম আজাদ এই ব্যবসা শত কোটি টাকার মালিক বনে না গেলেও তাঁর গুরু হুন্ডি ব্যবসার মূলহোতা সজীব কয়েকশ কোটি টাকার মালিক। এ ব্যবসা করে সিঙ্গাপুর সজীব গড়েছেন সেকেন্ড হোম। ঐ দেশ থেকে তিনি বাংলাদেশে আজাদের মাধ্যমে হুন্ডির মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব নাম্বারে টাকা লেনদেন করেন। কিছুদিন আগে বিদেশ থেকে সরকারের যে রেমিট্যান্স বেড়েছে তা আজ কমতে শুরু করেছে এই সিন্ডিকেটের কারনে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের নিয়মনীতি মেনে যদি এই টাকা বাংলাদেশে আসতো তাহলে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পেত কয়েকশো গুণ। আবার এ দেশের কালোবাজারি টাকাও বন্ধ হত।
জানা গেছে, দেশের বেশিরভাগ টাকা পাচার হয় সফিউল আলম আজাদ ও সিঙ্গাপুরের সজীবের মাধ্যমেই। এ সংক্রান্ত একাধিক তথ্য প্রমাণ আমাদের হাতে রয়েছে। সফিউল আলম আজাদের গ্রামের বাড়ী মাদারীপুর, তিনি দীর্ঘদিন ঢাকার উপশহর খ্যাত ওয়ারী বসবাস করে এ ব্যবসা পরিচালনা করেন। তার পাসপোর্ট নং- ইই ০৪১৯৯৮৬ এবং পূর্ববর্তী পাসপোর্ট নং- বিএইচ ০৪১৫০৯৮ ইস্যু তারিখ ১৪ নভেম্বর ২০১৯ এবং মেয়াদ শেষের তারিখ ১৩ নভেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত। পাসপোর্টে জন্ম নিবন্ধন নাম্বার দেওয়া হয়েছে। যাহার ব্যক্তিগত নং ১৯৮৮৫৪১৫৪২৯১০৫১৩১। বাংলাদেশ থেকে যাঁরা সেকেন্ড হোম গড়তে সিঙ্গাপুর বা মালেশিয়া টাকা পাচার করে তারা সফিউল আলম আজাদের কাছে টাকা জমা দিলেই ওই দেশে সজীব বা তার প্রতিনিধি টাকা/ ডলার দিয়ে দেন। আবার যারা মালেশিয়া থেকে বাংলাদেশে টাকা/ডলার পাঠাবেন তাদের টাকা/ডলার সজীব বা তার যেকোন প্রতিনিধির কাছে দিলে সজীব বাংলাদেশে সফিউল আলম আজাদকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপ বা টেলিগ্রামে ব্যাংক হিসাব নাম্বার দিলে আজাদ আবার বিভিন্ন এড়িয়ার প্রতিনিধি বাবুয়া, নাসের, ইয়াদুল ইসলাম, নাদিরা, দেবাশীষ, মুন্না, রাসেল সহ আরো অনেকে ব্যাংক হিসাব নাম্বার দিয়ে বলে দেন টাকা দিয়ে দিতে। সারা বাংলাদেশে প্রায় কয়েকশ নাম্বারে কোটি কোটি টাকা পাঠিয়েছেন এই চক্রটি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের নওগাঁ শাখায় ব্যাংক হিসাবধারীর নাম ই-সপ, হিসাব নং ২০৭১১০০০১১২২০ তে ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর ৩ লক্ষ টাকা পাঠানো হয়। একই ব্যাংকের একই শাখায় আরমান টেলিকম নামের হিসাব নং ২০৭১১০০০১০৩৫৬ তে একই দিন পাঠানো হয় ৩ লক্ষ টাকা। এই তারিখে অগ্রনী ব্যাংক গাজীপুর শাখায় মোঃ মনিরুজ্জামানের হিসাব নং ০২০০০০৪৬৯৯৮২৩ ডিপোজিট করে পাঠানো হয় ২ লক্ষ টাকা। একই তারিখ ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ফেনি শাখায় ফ্যামেলি ফ্যাশন নামের হিসাব নং ১৪০ ১১০ ১৯১১৪ তে পাঠানো হয় ৫ লক্ষ টাকা, এছাড়াও একই ব্যাংকের এই শাখায় ওমিত এন্টারপ্রাইজ নামের হিসাব নং ১৪০ ১১০ ২১৫৩০ তে পাঠানো হয় ৫ লক্ষ টাকা। এই দিন শরিয়তপুরের অগ্রণী ব্যাংক ডামুড্যা শাখায় মেসার্স সম্রাট টেইলার্স এন্ড টেলিকম নামের হিসাব নং ০২০০০১৩৮১২৯২৬ একাউন্টে ২ লক্ষ টাকা পাঠানো হয়। অগ্রণী ব্যাংক হোমনা শাখায় আলী মিয়া নামের হিসাব নং ০২০০০১১৯১৩৪৪৯ একাউন্টে পাঠানো হয় ২ লক্ষ টাকা। ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংক লিমিটেড হোমনা শাখায় মোঃ কাইয়ুম মিয়া নামের হিসাব নং ০২৫৭১২২০০০০০৯৮৬ একাউন্টে পাঠানো হয় ২ লক্ষ টাকা। অগ্রণী ব্যাংক ভৈরব বাজার শাখায় এমএস মোরশেদ ট্রেডার্স নামের হিসাব নং ০২০০০১৩৪৬৫৬৮২ তে পাঠানো হয় ৪ লক্ষ টাকা। আল আরাফাহ ইসলামি ব্যাংক লিমিটেড আশুগঞ্জ শাখায় এমএস সাদ্দাম এন্টারপ্রাইজ নামের হিসাব নং ১৩০১০২০০০৪৩৭২ এ পাঠানো হয় ২ লক্ষ টাকা। মার্চেন্টটাইল ব্যাংক হেমায়েতপুর শাখায় এমএস এমএস ট্রেডিং নামের হিসাব নং ১১৩০১১১২২২৪৭৫০১ একাউন্টে দেওয়া হয় ৪ লক্ষ টাকা।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে ২০ ডিসেম্বর ২০১৯ সালে ব্রাক ব্যাংক গৌরীপুর শাখায় চন্দন দাস নামের হিসাব নং ১৩০২২০৪২২৬৬৮৯০০১ একাউন্টে ২ লক্ষ টাকা পাঠানো হয়। যমুনা ব্যাংকের জুরাইন এসএমই সার্ভিস সেন্টার, ঢাকার মা টেলিকম নামের হিসাব নং ০৪৭-০২১০০১৫৪৫০ একাউন্টে পাঠানো হয় ১০ লক্ষ টাকা। এমন করে প্রায় দৈনিক ২ শত ব্যাংক হিসাব নাম্বারে টাকা পাঠান এই হুন্ডি ব্যবসায়ী চক্রটি।
এদিকে শাহ আলম ভোলন নামের আরেক হুন্ডি ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেছেন এক ব্যক্তি। হুন্ডি ব্যবসা করেই ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন শাহ আলম। রাজধানীর বিভিন্ন শপিংমলে একাধিক দোকান ও বিভিন্ন কয়েকটি ফ্ল্যাট গড়ে তুলেছেন তিনি। অভিযোগে বলা হয়, মাদক সেবন, নারীবাজি ও বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত শাহ আলম।
অভিযোগে বলেন, মোঃ শাহা আলম ভোলন দীর্ঘ বছর যাবৎ কতিপয় অসাধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সুসম্পর্ক করে, তাদের মোটা অংকের মাসিক মাসোহারা দিয়ে অবৈধভাবে স্বর্ণ চোরাচালানী সহ হুন্ডি ও অস্র ব্যবসা করে আসছে। এই স্বর্ণ, হুন্ডি ও অবৈধ অস্ত্র ব্যবসার কারণে দেশ ও জাতির অপূরনীয় ক্ষতি হচ্ছে। সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব শাহা আলম ভোলন তার সাথে আরও ৪ জনকে নিয়ে দেশ ও বিদেশে একটি শক্তিশালী হুন্ডি ও স্বর্ণ চোরাচালান এবং অবৈধ ভাবে অস্ত্র ব্যবসা করার সিন্ডিকেট দল তৈরি করেছে। তাদের জন্য দেশে কতিপয় যুবক অপরাধের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে।
শাহ আলমের স্থায়ী বাড়ি পুরান ঢাকার ধুপখোলা কিন্তু সে অত্যাধুনিক ফ্ল্যাট ক্রয় করেছে পরিবাগ দিগন্ত টাওয়ারে। এখানে সে তার পরিবারে নিয়ে থাকেন। তার পুরো পরিবার নেশাগ্রস্ত। তার স্ত্রীর সাথে প্রায় দিনই নেশা নিয়ে দ্বন্দ্ব হয়। বর্তমানে তার স্ত্রী রিহ্যাবে ভর্তি আছে। শাহা আলমের এলিফ্যান্ট রোডে মোতালেব প্লাজায় ১৪ টি দোকান রয়েছে। এছাড়া তার আলু বাজারেও একাধিক দোকান রয়েছে। তার ৬ নং ডি আইটি রোড বিল্ডিংয়ের টপ ফ্লোর তার ক্রয় করা সেখানে ও তার গোপনীয় অফিস রয়েছে। তার দুই জন সন্তান তাদের একটি ব্যয়বহুল স্কুলে পড়ান। তার দুইটি গাড়ি রয়েছে ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো, অন্যটি প্রিমিও। সে প্রতিদিন তার মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দেশ বিদেশে তথ্য আদান প্রদান করে থাকে। সে কোটি কোটি টাকার অবৈধ ব্যবসা করে। কিন্তু তার বৈধ্য ব্যবসা হিসেবে কোন ধরনের কাগজ পত্র নেই বা কোথাও তার কোন ব্যবসায়ীক সাইনবোর্ড বা অফিস কর্মচারী নাই এছাড়া কোন ব্যবসায়ী নথিপত্র রাজস্ব বোর্ডে নাই। অথচ তার কোটি কোটি টাকা প্রতি মাসে আয় হয় কি ভাবে তার প্রশ্ন থেকে যায়? সে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনে টাকা দেয়া সহ সব ধরণের সহযোগিতা করেছেন। মোতালেব প্লাজায় তার একটি গোপন কক্ষ রয়েছে। এখানে বসেই সকল অপরাধের কাজ গুলো করে থাকেন তিনি।
এসব বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, হুন্ডি ব্যবসায়ীদের হাত অনেক বড়। অভিযান দিয়ে গ্রেফতার করলে উল্টো নিজের উপর দায় দেওয়া হয়। এ কর্মকর্তা আরো বলেন, আমাদের অনেক লোকই এসব কাজের সহযোগিতা করেন। অনেকে হুন্ডি ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করে পরে ছিনতাই মামলাও খেয়েছে এমন নজির আছে। চাকরি হারিয়েছে অনেক পুলিশ সদস্য। আবার এখনো অনেক পুলিশ সদস্যকে বিভিন্ন ভাবে সাজা দেওয়া হয়েছে। এসব ভয়ে এই চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও নেই না। আগে একাধিক হুন্ডি ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করার চেষ্টা করেছি কিন্তু অভিযান দেওয়ার সাথে সাথেই কোন না কোন পুলিশ সদস্য ফোন করে নিজের আত্মীয় স্বজন বলে পরিচয় দিয়ে গ্রেফতার করতে না বলেন। দেশের কথা চিন্তা করে মাঝে মাঝে ভাবি চক্রটা গ্রেফতার করি কিন্তু বাধা তো একটা নয় আদালত থেকে জামিনে বের হয়ে একই কাজে আবার জড়িত হয়। সমন্বয় করে কাজ করা গেলে এই হুন্ডি ব্যবসা বা টাকা পাচার রোধ করা সম্ভব বলে জানান পুলিশের এই কর্মকতা।
‘টিউবওয়েলের পানি পান করে ফরিদপুরে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অসুস্থ’
ফরিদপুরের সালথা উপজেলার রামকান্তপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের টিউবওয়েলের পানি পান......বিস্তারিত