TadantaChitra.Com | logo

৪ঠা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১৮ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রধান শিক্ষা প্রকৌশলীর শ’ শ’ কোটি টাকার দুর্নীতি

প্রকাশিত : জানুয়ারি ৩০, ২০১৯, ০৫:১২

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রধান শিক্ষা প্রকৌশলীর শ’ শ’ কোটি টাকার দুর্নীতি

দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পুনঃনির্মাণ ও মেরামতের লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করেছিলো শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর বা ইইডি। ইতিপূর্বে এর নাম ছিল ফ্যাসিলিটিজ ডিপার্টমেন্ট। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভৌতঅবকাঠামো উন্নয়ন, নতুন ভবন নির্মাণ, পুনঃনির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত ও সংস্কারসহ আসবাবপত্র সরবরাহের মতো বিষয়গুলো এই অধিদফতরের দায়িত্বে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই দুর্নীতির স্বর্গে পরিণত হয়েছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর। আর এই দুর্নীতি জালিয়াতি ও অনিয়মের নেতৃত্বে রয়েছেন বহুল সমালোচিত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ইইডি’র খোদ প্রধান প্রকৌশলী দেওয়ান মোহাম্মদ হানজালা। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরে দুর্নীতি-লুটপাটের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন তিনি। দেওয়ান মোহাম্মদ হানজালার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে গড়ে ওঠা এই সিন্ডিকেটে রয়েছেন সাবেক শিক্ষা মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের শ্যালক, এপিএস এবং হানজালার নিজের আপন ভাইসহ পরিবারের সদস্যরা। নামে-বেনামে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের সারাদেশে প্রায় সব টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করছে এই সিন্ডিকেট। হানজালার ছোটভাই আবদুল হাই ছাড়াও, তার বড় ভাই, ভাতিজা, নিজের শ্যালক, ভাইয়ের শ্যালক, আপন খালাতো ভাই এবং একাধিক বন্ধু এই সিন্ডিকেটের সদস্য। সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটিকে প্রধান প্রকৌশলী তার অবৈধ অর্থ আয়ের সুবিধার জন্য বলতে গেলে তার নিজের এবং মন্ত্রীর পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে ফেলেছেন। প্রধান প্রকৌশলীর কার্যালয়ে কর্মরত কয়েকজন প্রকৌশলীও এই সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে কাজ করছেন। সরকারের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মেরামত ও সংস্কারের নামে সিন্ডিকেটটি হাতিয়ে নিয়েছে শ’ শ’ কোটি টাকা। কাজ না করেই কাজের ভুয়া অগ্রগতি দেখিয়ে বিল তুলে নেয় এই সিন্ডিকেট। অধিকাংশ মেরামত ও সংস্কার কাজেরই এ অবস্থা। অন্যদিকে নতুন যেসব নির্মাণ কাজ হচ্ছে তাও অত্যন্ত নিম্মামানের। অধিদফতরের অধীনে নির্মিত বহু প্রতিষ্ঠানের কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে দুর্নীতি ও এখন বলা যায় ওপেন সিক্রেট। আছে সীমাহীন কমিশন বাণিজ্য। অভিযোগ আছে, উন্নয়ন কাজের দরপত্র প্রক্রিয়ার শুরুতেই নির্দিষ্ট হারে কমিশন চলে যায় প্রধান প্রকৌশলীর পকেটে। মোটা অঙ্কের কমিশনের বিনিময়ে কাজ দেওয়া, সর্বনিম্ন দরদাতাকে জোরপূর্বক টেন্ডার প্রত্যাহার, প্রকল্প পিছিয়ে বাজেট বাড়ানো, নির্মাণকাজে অবহেলা, ভুতুড়ে কাজের নামে বিল ও ভুয়া ভাউচার তৈরি করে সরকারি অর্থ আত্মসাতসহ নানা অনিয়ম প্রতিষ্ঠানটিতে নিয়মিত ঘটছে। গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের ছত্রছায়ায় থেকেই হানজালা প্রতিষ্ঠানটিতে রাম-রাজত্ব কায়েম করে রেখেছেন। প্রধান প্রকৌশলী এবং তার আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত কয়েকজন নির্বাহী প্রকৌশলী ভুয়া বিল ভাউচার ও জাল-জালিয়াতিতে সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। একই কাজে একাধিকবার বিল তোলা হচ্ছে। আবার কাজ না করেও টাকা উত্তোলন করছে। আত্মীয়-স্বজন ও ঘনিষ্ঠদের ঠিকাদারী ফার্মের নামে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার কাজ নিয়ে তা না করে আত্মসাত করেন। অধিদপ্তরের কার্যক্রমে একরকমের নৈরাজ্য চলছে বলা যায়। কোন নীতিমালা কিংবা নিয়ম কানুন নয়, ব্যক্তির মর্জিতেই চলছে সবকিছু।
সূত্রমতে, ২০১৪ সালে দেওয়ান মোহাম্মদ হানজালাকে প্রধান প্রকৌশলী পদে নিয়োগের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে অনিয়মের বীজ বপণ করা হয়। কেননা, পদোন্নতি না দিয়ে এবং ৫জন সিনিয়র তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে সুপারসিড করে ২০১৪ সালে হানজালাকে প্রধান প্রকৌশলী পদে নিয়োগ দেয়া হয়। নিজের ক্ষমতাকে পোক্ত রাখতেই হানজালা নানা কূট কৌশলে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদেও নিয়োগ দিতে দেননি ৩-৪ বছর। এমনকি বেনামে বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ পাঠিয়ে অনেক প্রকৌশলীদের কব্জা করে রাখেন বলেও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
কার্যাদেশ নিয়ে সিন্ডিকেটের পুকুরচুরি 
অবৈধ উপায়ে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও সংস্কারের কার্যাদেশ নিয়ে রীতিমতো পুকুরচুরি করছে সিন্ডিকেটটি। কোথাও রডের পরিবর্তে বাঁশ দিয়ে নির্মাণ কাজ করানো হচ্ছে, কোথাও আবার রড বা বাঁশ ছাড়াই শুধুমাত্র সিমেন্ট-বালি দিয়ে কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। একাধিকবার এসব ঘটনা হাতেনাতে ধরা পড়ে যাবার পর প্রধান প্রকৌশলী নিজে বাঁচার জন্য অন্য প্রকৌশলীদের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করেন। তিনি কাউকে কাউকে লোক দেখানো শোকজও করেন। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সব অনিয়মের সঙ্গেই প্রধান প্রকৌশলী সরাসরি জড়িত। প্রত্যেকটি টেন্ডারের আর্থিক অনুমোদন তার হাতেই চূড়ান্ত হয়। তাছাড়া মাঠ পর্যায়ে অর্থাৎ কাজের বাস্তবায়ন পর্যায়ে প্রধান প্রকৌশলীর নির্ধারিত সিন্ডিকেটের লোকজন রয়েছেন। তাদের সঙ্গে প্রধান প্রকৌশলীর সরাসরি যোগাযোগ আছে। কে কী করছে বা করছে মা প্রধান প্রকৌশলী সবই জানেন। কাজে ফাঁকি, অনিয়ম-দুর্নীতি কোন কিছুই তার নজরের বাইরে নয়।
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের শুধু ঢাকা মেট্রো জোনের ২০১৭ সালের জুন মাসের ১০৮টি কাজ পর্যালোচনা করে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়। এরমধ্যে দু’চারটি নতুন নির্মাণের কার্যাদেশ ছাড়া বাকি সবই ছিলো মেরামত ও সংস্কার সংক্রান্ত। এছাড়া মেট্রো জোনেই নয়, ইইডির সারা দেশের কার্যক্রমেই একই চিত্র। নামে-বেনামে এসব কাজ বাগিয়ে নেন প্রধান প্রকৌশলী হানজালার ভাই, ভাতিজা, খালাতো ভাই, বন্ধু-বান্ধব। এছাড়া মন্ত্রীর শ্যালকসহ সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যরাও এসব অনিয়মের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। কাজ না করেই এসব কাজের টাকা তুলে নেয়া হয়েছিলো। সাধারণত মেরামত ও সংস্কার কাজে প্রতিটিতে বরাদ্দ থাকার কথা ৩-৪ লাখ অথবা ৫ লাখ টাকা। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে, অনেক কাজেই বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১০ লাখ টাকার বেশি। কোন কোনটি ১৫ লাখ-২০ লাখ টাকা পর্যন্ত। যেটা ইতিপূর্বে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের জন্য অকল্পনীয় বিষয় ছিল। লুটপাটের সুবিধার জন্যই একেকটি কাজে এতো বেশি বরাদ্দ দেয়া হয় বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছেন।
জানা যায়, প্রধান প্রকৌশলী নিজের সুবিধার্থে ঢাকা জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে আবুল কালাম মো. আক্তারুজ্জামানকে পদায়নের ব্যবস্থা করেন। সিনিয়র প্রকৌশলীদের ডিঙিয়ে অত্যন্ত দুর্নীতিবাজ বলে পরিচিত এই কর্মকর্তাকে ঢাকা জোনের দায়িত্ব দেয়া হয়। জানা গেছে, আক্তারুজ্জামান ঢাকার নির্বাহী প্রকৌশলী পদে যোগদানের পর তার হাত দিয়েই এসব টেন্ডারের কার্যাদেশ প্রদান এবং বিল পরিশোধ হয়েছে। তবে এসব ক্ষেত্রে প্রধান প্রকৌশলী দেওয়ান মোহাম্মদ হানজালার আপন ভাই দেওয়ান মোহাম্মদ আবদুল হাই এবং মন্ত্রীর শ্যালক শামীমের নির্দেশনা অনুযায়ীই সবকিছু চলছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। হাই নিজেই প্রায় ১০ কোটি টাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মেরামত কাজ  নিয়ে মেরামত না করেই শুধুমাত্র চুনকাম করেই এসব বিল তুলে নেন। আবদুল হাই নিজের প্রতিষ্ঠান পদ্মা কনস্ট্রাকশন ছাড়াও স্ত্রীর প্রতিষ্ঠান মেসার্স ফিরোজা এন্টারপ্রাইজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে কাজ নিয়েছেন। তবে এক্ষেত্রে কিছুটা কৌশল খাটিয়েছেন। নিজের প্রতিষ্ঠানের নামে নিয়েছেন ছোটখাটো কাজ। অন্যদিকে বড় কাজগুলো নিয়েছেন নিজের স্ত্রী এবং বন্ধু-বান্ধবদের প্রতিষ্ঠানের নামে। যাতে দুর্নীতিতে ধরা না পড়েন সেই উদ্দেশ্যেই তিনি এমন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু, তার এ অপকর্ম হাতেনাতে ধরা পড়ে যায়। আজিমপুরস্থ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের একটি নির্মাণ কাজের টেন্ডারে কার্যাদেশ দেয়া হয়েছিল ১ কোটি ৬৯ লাখ টাকার। আবদুল হাইয়ের বন্ধুর প্রতিষ্ঠান মেসার্স শামস এন্টারপ্রাইজের নামে কার্যাদেশটি দেয়া হয়েছিল। ২০১৭ সালের ২৫ জুন এই প্রতিষ্ঠানকে ৬৫ লাখ টাকার বিল পরিশোধ করা হয়। এর তিন দিন পর ২৯ জুন একই কাজের জন্য আরো ৩৫ লাখ টাকার বিল পরিশোধ করা হয়। তিন দিনের মাথায় নতুন করে ৩৫ লাখ টাকার কাজের অগ্রগতির বিল পরিশোধের ঘটনায়ই প্রমাণিত হয় যে, এসব বিল পরিশোধে কতটা অনিয়মের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। বাস্তবে তখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি তেমন কিছুই ছিল না। কাগজে-কলমে ভুয়া অগ্রগতি দেখিয়েই এ বিল পরিশোধ করা হয়েছে।
জানা যায়, ইডেন কলেজ সম্প্রসারণ বাবদ ২ কোটি ১৭ লাখ ৫ হাজার ৫শ’ ১৩ টাকার কার্যাদেশ এবং গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের ৪ তলা হোস্টেল ভবনের টয়লেট ব্লকসমূহের স্যুয়ারেজ মেরামত-সংস্কার বাবদ ১৪ লাখ ৩৫ হাজার ৮৬৪ টাকার কার্যাদেশ পায় মেসার্স ফিরোজা এন্টারপ্রাইজ। এই প্রতিষ্ঠানটি আবদুল হাইয়ের স্ত্রীর। টেকনিক্যাল টিচার্স ট্রেনিং কলেজের একাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবনের বৈদ্যুতিক বিতরণ লাইনের মেরামত বাবদ ১০ লাখ ৮৯ হাজার ৯২৭ টাকার কাজ বন্ধুর প্রতিষ্ঠান মেসার্স শামস এন্টারপ্রাইজের নামে নিয়ে আবদুল হাই নিজেই তা করেছেন। গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের ৩ তলা হোস্টেলের টয়লেট ব্লকসমুহের পানির লাইন ও স্যুয়ারেজ মেরামত-সংস্কার বাবদ ১৫ লাখ ৩৬ হাজার ২৯ টাকার কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে আবদুল হাইয়ের শ্যালকের প্রতিষ্ঠান মেসার্স ফয়সাল এন্টারপ্রাইজের নামে। সরকারি বিজ্ঞান কলেজ প্রধান শিক্ষকের কক্ষ সংলগ্ন স্টোর রুমের সম্প্রসারণ কাজ (১৯ লাখ ৯৯ হাজার টাকার), গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ ৩ তলা শিক্ষক কোয়ার্টারের মেরামত ও সংস্কার কাজ (১৪ লাখ ৯১ হাজার টাকার)সহ ৪টি কাজ পেয়েছে মেসার্স সপ্তদীপা সংসদ। এই প্রতিষ্ঠানটির মালিক আবদুল হক, যিনি প্রধান প্রকৌশলী দেওয়ান মো. হানজালার আপন খালাতো ভাই। হানজালার বাসায়ই তিনি বসবাস করেন। টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ, ধানমন্ডি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের উভয় ব্লকের ছাদের জলছাদ ও সংস্কার কাজ, ধানমন্ডি গার্লস স্কুল- উত্তর ব্লকের মেরামত কাজ এবং ধানমন্ডি গার্লস স্কুল- নামাজ রুমের মেরামত কাজ পেয়েছেন প্রধান প্রকৌশলী হানজালার আরেক খালাতো ভাই গোলাম মোস্তফার প্রতিষ্ঠান মেসার্স জিএম এন্টারপ্রাইজ। ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট- দক্ষিণ গেট মেরামত ও সংস্কার কাজ (৯ লাখ ৪৫ হাজার ৫৪ টাকার) পেয়েছে হানজালার আপন বড় ভাইয়ের প্রতিষ্ঠান মেসার্স আব্দুল্লাহ এন্টারপ্রাইজ। হানজালার ছোট ভাই আবদুল হাইয়ের বন্ধুর প্রতিষ্ঠান মেসার্স রাফিদ ইন্টারন্যাশনাল ইডেন মহিলা কলেজের ৬টি আলাদা বড় কাজ পেয়েছে, যার ৫টিই মেরামত ও সংস্কার সংক্রান্ত। এগুলো হলো, সরকারি ইডেন মহিলা কলেজ-শহীদ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রী নিবাসের ভিতরের (দক্ষিণ পার্শ্বের) মেরামতসহ প্লাস্টিক পেইন্টের (১৫,৩৭,৮০২ টাকার) কাজ, সরকারি ইডেন মহিলা কলেজ-শহীদ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রী নিবাসের মেরামত ও সংস্কার (১৫ লাখ ৩০ হাজার ৪১০ টাকার) কাজ, সরকারি ইডেন মহিলা কলেজ-শহীদ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রী নিবাসের বাহিরের অংশের (১৩ লাখ ৯৯ হাজার ৬৬৯ টাকার) কাজ, সরকারি ইডেন মহিলা কলেজ-শহীদ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রী নিবাসের পাম্প মোটর স্থাপনসহ পানির লাইন মেরামত (২০ লাখ ৮২ হাজার ৭৩৯ টাকার) কাজ, ইডেন মহিলা কলেজ- বাস্কেট বল, টেনিস ও প্লেগ্রাউন্ড নির্মাণ (২৯ লাখ ৭৪ হাজার ৮৬৬ টাকার) কাজ এবং ইডেন মহিলা কলেজ- ২ নং ভবনের বিভিন্ন মেরামত ও রং করণ (৯ লাখ ৯১ হাজার ৫০০ টাকার) কাজ। এ কাজগুলো বন্ধুর প্রতিষ্ঠানের নামে নেয়া হলেও কাজের মালিকানা আসলে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী হানজালার ভাই আবদুল হাইয়ের নিজেরই।
আবদুল হাইয়ের আরেক বন্ধুর প্রতিষ্ঠান মেসার্স রিফাত এন্টারপ্রাইজ পেয়েছে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের আলাদা ৬টি মেরামত ও সংস্কার কাজ। ঢাকা জোনের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মির্জা নজরুল ইসলামের আপন ভাই মির্জা আমিনুল ইসলাম পেয়েছেন ৪টি মেরামত ও সংস্কার কাজ। সংশ্লিষ্টমহলের অভিযোগ, টেন্ডারে ম্যানিপুলেট করা না হলে কোন ক্রমেই একটি প্রতিষ্ঠান এতোগুলো কাজ পাওয়া সম্ভব নয়। নির্বাহী প্রকৌশলী ছাড়াও এই ম্যানিপুলেশনের সঙ্গে প্রধান প্রকৌশলী দেওয়ান মোহাম্মদ হানজালা সরাসরি জড়িত।
তবে প্রধান প্রকৌশলী দেওয়ান মোহাম্মদ হানজালাকে এসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, আমার ভাই-ভাতিজা কী তাহলে ব্যবসা করবে না? তিনি দাবি করেন, সবগুলো কাজই নিয়ম-মাফিক হচ্ছে।
মোজাইকের বদলে টাইলস দিয়ে আড়াই কোটি টাকা লোপাটের ধান্ধা 
জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ ভবন নির্মাণ প্রকল্পে দুটি ফ্লোরে সিডিউল আইটেম মোজাইকের পরিবর্তে টাইলস দিয়ে প্রায় দুই কোটি টাকা লোপাটের ধান্ধা করেছেন ইইডির প্রধান প্রকৌশলী দেওয়ান হানজালা সিন্ডিকেটের এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন ২০১৬ সালের ২৩ নভেম্বর এক চিঠিতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নিষেধাজ্ঞা দেয়া সত্ত্বেও দু’টি ফ্লোরের সিডিউল আইটেম মোজাইকের বদলে ঠিকাদার বাড়তি অর্থ লোপাটের জন্য  টাইলস স্থাপন করেছেন। মোজাইকের বদলে এই টাইলস স্থাপন করে দেওয়ান হানজালা সিন্ডিকেটের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দি বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স এন্ড দেশ উন্নয়ন লিমিটেড অতিরিক্ত ২ কোটি ৪৮ লাখ ৯ হাজার ৪০০ টাকা হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। ২০১৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন  শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর ঢাকা জোনের  নির্বাহী প্রকৌশলীকে  এক চিঠিতে টাইলস লাগিয়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায় বা সংশোধিত প্রাক্কলন অনুমোদনকে সম্পূর্ণভাবে পিপিআর লঙ্ঘন বা বেআইনি বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু তারপরেও সংশোধিত প্রাক্কলনে অনুমোদন দিতে  ২০১৮ সালের ১২ ডিসেম্বর ইইডির প্রধান প্রকৌশলীর পক্ষে নির্বাহী প্রকৌশলী জয়নাল আবেদীন এক চিঠিতে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে লেখেন। এমনকি এই বেআইনি অনুমোদনের জন্য বিভিন্নভাবে তাকে চাপপ্রয়োগ করা হয়েছে বলেও তিনি অভিযোগ উঠেছে। এই চিঠিই প্রমাণ করে ইইডির প্রধান প্রকৌশলী দেওয়ান হানজালা সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত বলেই বেআইনি হলেও অতিরিক্ত অর্থ লোপাটের জন্য সংশোধিত প্রাক্কলনে অনুমোদন দেয়ার জন্য তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে চাপা দেয়া হচ্ছে।
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হয়েও সুবিধাভোগী 
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী দেওয়ান মোহাম্মদ হানজালার আদি নিবাস মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার আজিমনগর গ্রামে। সহকারী প্রকৌশলী হিসাবে চাকরিতে যোগদান করেন তিনি ১৯৮১ সালে ১২ ডিসেম্বর। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে পদোন্নতি পেয়ে প্রধান প্রকৌশলী হন। নিয়মানুযায়ী তার চাকরির মেয়াদ পূর্ণ হবার কথা ২০১৫ সালের ৭ জুলাই। কিন্তু বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারি চাকরির বয়সসীমা বাড়ানোর পর জালিয়াতি আর ধূর্ততার আশ্রয় নেন প্রধান প্রকৌশলী হানজালা। নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেই চাকরির এক বছর বর্ধিত মেয়াদ বাগিয়ে নেন। সেসময় নিজের দাবির সপক্ষে তিনি মুক্তিযোদ্ধার সাময়িক সনদ উপস্থাপন করেন। হানজালার রাতারাতি মুক্তিযোদ্ধা বনে যাবার গল্প নিয়ে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের মাঝে সন্দেহ ছিলো শুরু থেকেই। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট দফতরে অভিযোগও দেয়া হয়। তবে কোনো অভিযোগই আমলে নেয়া হয়নি। বরং বিভিন্ন মহলে মোটা অংকের উৎকোচ আর নানা কূট কৌশলে বর্ধিত মেয়াদ শেষে আরো দুই বছরের চুক্তি বাগিয়ে নেন হানাজালা। গত বছরের ১৭ জুলাই তার সেই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ আরো এক বছরের জন্য বাড়িয়ে দেয়া হয়। সরকারি বিধি মোতাবেক মুক্তিযোদ্ধাদের চাকুরিতে যোগদানের সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে। অন্যথায় তিনি মুক্তিযোদ্ধা হলেও চাকুরির বর্ধিত সময়-সুযোগ ভোগ করতে পারবেন না। ২০১৫ সালের ৪ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন যুগ্মসচিব গোলাম রহমান মিঞা স্বাক্ষরিত একটি চিঠি সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে প্রেরণ করা হয়। ‘চাকুরিরত মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে সরকারি নির্দেশনা’ শিরোনামের ওই চিঠিতে চাকুরিতে যোগদানের সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা না দিয়ে যারা সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে সশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমস্ত সুযোগ সুবিধা অতি দ্রুত বাতিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে হানাজালা চাকরিতে যোগদানের সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দেননি। অথচ হানজালারা রয়ে গেছেন অধরা। জানা গেছে, তার মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্রটি ‘সাময়িক সনদপত্র’। সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক সাময়িক সনদপত্র বা মূচলেকা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এই সংক্রান্ত অনুশাসন জারি আছে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক প্রতি স্বাক্ষরিত সনদ কিংবা লাল মুক্তিবার্তায় তালিকাভুক্তরাই কেবল মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুবিধা পাবার দাবিদার। অথচ হানজালার মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোন প্রতিস্বাক্ষর নেই। লাল মুক্তিবার্তায়ও হানজালার নাম নিবন্ধিত নেই। তারপরও তিনি কিভাবে মুক্তিযোদ্ধা হলেন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের সবার কাছে এটি বিস্ময়।


যোগাযোগ

বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যলয়

কাব্যকস সুপার মার্কেট, ৩ ডি কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫।

মোবাইলঃ ০১৬২২৬৪৯৬১২, ০১৬০০০১৪০৪০

মেইলঃ tadantachitra93@gmail.com, tchitranews@gmail.com

সামাজিক যোগাযোগ

Web Design & Developed By
A

তদন্ত চিত্র কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েব সাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি।