TadantaChitra.Com | logo

১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

নিজেদের পাপে নবজাতক লাশ কেন ?

প্রকাশিত : মে ২৮, ২০১৯, ১৯:৩০

নিজেদের পাপে নবজাতক লাশ কেন ?

( মোঃ তানভীর শেখ )

কেউ একটি বাচ্চার আশায় জীবনের সব সম্পদ লুটিয়ে দেয় আবার কেউ অবৈধ সম্পর্কের বদনাম গুজতে নবজাতককে বলি দেয়।  প্রতিনিয়তই পাওয়া যাচ্ছে নবজাতকের লাশ। ডাস্টবিন, রাস্তা কিংবা ঝোপঝাড়ে, যেসব অজ্ঞাত শিশুর লাশ পাওয়া যাচ্ছে তাদের ৯৯ ভাগই নবজাতক।
এদের পরিকল্পিতভাবে জন্মের পরেই রাস্তায়, ডাস্টবিন-ভাগাড়, ঝোপঝাড়, উঁচু স্থান কিংবা বাথরুম থেকে ফেলে দেয়া হচ্ছে। যাদেরকে জীবিত পাওয়া যায়, তাদের মূলত হত্যার উদ্দেশ্যেই সেখানে ফেলে দেয়া হয়। জীবিত কিংবা মৃত অবস্থায় নবজাতককে উদ্ধার করা হলেও ঘটনায় জড়িতরা বরাবরই থেকে যাচ্ছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। পুলিশ বলছে, এসব ঘটনায় দায়ের করা মামলায় তথ্যপ্রমাণের ঘাটতি থাকে। তাছাড়া বাদী-বিবাদী না থাকায় আগ্রহ কম থাকে। তাই জড়িতদের অনেক সময় চিহ্নিত করাও সম্ভব হয় না। সমাজবিজ্ঞানীরা এ অবস্থাকে সমাজের চরম নৈতিক অবক্ষয় হিসেবে মন্তব্য করেছেন। তারা বলছেন, নারী-পুরুষদের অবৈধ মেলামেশার ফলে যে সন্তান জন্ম নিচ্ছে তা সমাজ এবং তাদের পরিবার মেনে নেয় না। ফলে জন্মের পরপরই এসব নবজাতকদের ঠাঁই হচ্ছে ডাস্টবিনে। তবে বৈধ সম্পর্কের ফলে জন্ম নেওয়া নবজাতকদের ক্ষেত্রেও যে এমনটা ঘটছে না তা নয়। অনেক পরিবারে পুত্র সন্তান আশা করছে। কিন্তু জন্ম নিচ্ছে কন্যা সন্তান। তখন অনেকে সেই কন্যা সন্তানকে পরিত্যাগ করতে তাকে ফেলে দিচ্ছে ডাস্টবিনে। কেউ মারা যাচ্ছে। কেউ বা বেঁচে যাচ্ছে ভাগ্যগুণে।
এই বছরের ১৫ই মে শিশু হাসপাতালের টয়লেট থেকে ফুটফুটে জীবিত এক নবজাতককে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারের পর সেই নবজাতকের ঠিকানা হয় আজিমপুর শিশুমনি নিবাস। এ ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শেরেবাংলা নগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) দায়ের করেছেন। কিন্তু কে বা কারা শিশুটিকে ফেলে গেছে তার হদিস নেই।
সপ্তাহও গেল না আবার ২২ মে রাজধানীর হাতিরঝিলে ময়লার স্তূপ থেকে এক নবজাতকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায়ও হাতিরঝিল থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করা হয়। তবে কে ময়লার ঝুড়িতে নবজাতকের লাশটি ফেলে গেল তার হদিস(সন্ধান) পাওয়া গেল না। শিশুটির ডিএনএ প্রোফাইল রাখা হয়। ছবি করেও রাখা হয়েছে। তবে ঘটনায় জড়িত কাউকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। আসলে এসব ঘটনা তো পরিকল্পিতভাবে করা হয়। এই ঘটনার একদিন পার না হতেই আবার ২৩ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের পাশের ফুটপাত থেকে শপিং ব্যাগ মোড়ানো অবস্থায় একদিনের এক নবজাতকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায়ও শাহবাগ থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়। এবারও পুলিশ নিশ্চিত হতে পারেনি, শিশুটির জনক-জননী কে। একটু বছরের শুরুতে যাই ২৭ জানুয়ারি কার্জন হলের বিপরীত পাশ থেকে কার্টনের ভেতরে এক নবজাতকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। কিন্তু ওইসব এলাকায় সিসি ক্যামেরা না থাকায় এ ঘটনায়ও জড়িতদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। আবার সেই দিনই ২৭ জানুয়ারি উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টর এলাকা থেকেও ময়লা ডাস্টবিন থেকে আরেকটি নবজাতকের লাশ উদ্ধার করে উত্তরা থানা পুলিশ।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৫ সালে পাওয়া গেছে ৫২ জন পরিত্যক্ত নবজাতককে, ২০১৬ সালে ২৮ জন, ২০১৭ সালে ২৪ জন এবং গত বছর প্রথম ৪ মাসে ২৭ জন অজ্ঞাত শিশুর লাশ পাওয়া গেছে। আসলে আমাদের মধ্যে তো মনুষ্যত্ব হারিয়ে যাচ্ছে, তার সাথে থাকা আদর-ভালোবাসাও হারিয়ে যাচ্ছে। তাই তো এই সুন্দর ফুটফুটে জীবিত একটা বাচ্চাকে ময়লার ভাগাড়ে, ঝোপঝাড়ে ফেলে আসতে কিংবা হত্যা করতে দ্বিধাবোধ কাজ করছে না। ভালোবাসার সময় ভালোবাসা তারপর কেন নিবো এই আবর্জনা। সমাজ যদি এই আবর্জনা টা দেখে ফেলে তাহলে তো আর আমার ভালোবাসার সম্মানই থাকবে না। বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে তো আর গৌরব করে বলতে পারবো না । লোকসমাজে মুখ দেখব কি করে! নিজের সন্তানকে হত্যা করলেই সব সমস্যার সমাধান। কেউ জানবেও না রাতে কিংবা নিরবে সুযোগ বুঝে ফেলে আসবো রাস্তায় কিংবা নদীর পাড়ে। কিন্তু তারা একটি বারও বুঝে না আমাদেরকে আগে মানুষ হতে হবে। তারপরে বন্ধুত্ব, ভালোবাসা একে অপরের হওয়ার আশা আকাঙ্ক্ষা। ভুলে গেলে হবে না সেই নবজাতকেরও বাঁচার অধিকার আছে সেও আমাদের মতো এই সুন্দর দুনিয়াকে উপভোগ করার অধিকার রাখে। পাপ করবা তোমরা জীবন কেন নবজাককে দিতে হবে? আমাদের সমাজে এ ধরনের ঘটনা আগেও ছিল। ইদানিং এটা বেড়ে গেছে। গার্মেন্টসে, বস্তিতে অনেক মেয়ে এমনকি অনেক উচ্চবিত্তের ঘরেও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সমাজে এই অবৈধ সন্তানদের পরিচয় দিতে পারছে না বলে তারা ফেলে দিচ্ছে। বিদেশে এসব বাচ্চার পুনর্বাসনের আইনও আছে।
তবে জীবিত কিংবা মৃত অবস্থায় নবজাতকের লাশ উদ্ধার করা হলেও ঘটনায় জড়িতরা বরাবরই থেকে যায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, পুলিশ এসব ঘটনাগুলোকে গুরুত্বসহকারে তদন্ত করছে না। তাই জড়িতদের চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে না। আর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেন, নবজাতক উদ্ধারের ক্ষেত্রে অপমৃত্যু মামলা হয়, আর তা গুরুত্বসহকারেই তদন্ত করা হয়। কিন্তু এখানে কিছু তথ্যা প্রমাণের ঘাটতি থাকে। বিশেষ করে বাদী-বিবাদী কম থাকে। তাই এসব মামলার আগ্রহটাও কম থাকে। আর উদ্ধারকৃত নবজাতকের লাশ ময়নাতদন্তের পর তার ডিএনএ প্রোফাইল করে রাখা হয়। যাতে সন্দেহভাজন কাউকে আটক করলে তার সাথে ডিএনএ মিলিয়ে দেখা যায়। কিন্তু ঘটনাটি ক্লু-লেস হওয়ায় অনেক সময় জড়িতদের আটক করা সম্ভব হয় না। আর ঢামেক হাসপাতাল মর্গ কর্তৃপক্ষ বলে, রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে মর্গে আসা নবজাতক ময়নাতদন্তের পর আঞ্জুমান মফিদুলের কাছে হস্থান্তর করা হয়। পরে তারা দাফনের ব্যবস্থা করেন।
এই তো সেদিন ২৫ মে নবজাতককে ৫ তলার বাথরুম থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করল গর্ভধারিণী মা। মিরপুর থানার রূপনগরের একটি ভবনের পঞ্চমতলা থেকে সদ্য ভূমিষ্ঠ নবজাতককে ফেলে দেওয়া সেই কিশোরী মাকেও পুলিশ আটক করেছে (বয়স ১৮ বছরের নিচে হওয়ায় নাম প্রকাশ করা হলো না)। ২৫ মে ওই নবজাতককে ৫ তলা ফেলে দিলে সঙ্গে সঙ্গেই তার মৃত্যু হয়। ওই ঘটনায় হত্যাকারী কিশোরী মাকে আটক করে পুলিশ। এ ঘটনায় রূপনগর থানায় ৪ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলাও দায়ের করা হয়। জানা গেছে, ঘটনার রাতেই কিশোরী মাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। এরপর বেরিয়ে আসে ঘটনার মূল রহস্য।
পুলিশ জানায়, নবজাতকের মা এ বছর এসএসসি পাস করেছে। জিজ্ঞাসাবাদে মেয়েটি জানায়, তার মা দুই বিয়ে করেছে। সে মায়ের প্রথম স্বামীর সন্তান। ওই বাসায় মা ও সৎবাবার সঙ্গে থাকত। সৎবাবার ছোট ভাই বিদেশে থাকেন।
সম্প্রতি দেশে ফিরে কয়েক মাসের জন্য রূপনগরের এ বাসায় ছিলেন। সে সময় তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের কারণে গর্ভবতী হয় সে। এরপর মা-বাবা তাকে গর্ভপাতের জন্য চাপ দেয়। ২৪মে ভোরে মেয়েটির প্রসব বেদনা ওঠে এবং ২৫মে সকাল সাড়ে ১১টায় টয়লেটে গিয়ে সে নিজেই সন্তান প্রসব করে। নবজাতকটি পৃথিবীতে আসার ৩০ মিনিট পর অর্থাৎ ১২টার সময় তাকে টয়লেটের ভেন্টিলেটর দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়।
এ ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলায় মেয়ের মা, সৎ বাবা ও তার সেই চাচাকে আসামি করা হয়েছে।
কি দোষ ছিল এই নবজাতকটির? সেই মাত্র ৩০মিনিট ছিলো এই দুনিয়ায় কিন্তু সে ৩০মিনিটে বুঝতে পারল এই দুনিয়া তার জন্য নহে। এখানে তার মতো যারা জন্ম নেয় তাদের কোনো স্থান নেই। আমাদের কাঁদিয়ে অভিশাপত এই সমাজ থেকে সে বিদায় জানান। পরিশেষে এইটুকুই বলব সৃষ্টিকর্তা সকলকে এমন পাপ কর্মের থেকে বিরত রাখার জ্ঞান দান করুক। আর যেন কোনো নবজাতককে অবৈধ সম্পর্কের বলি হতে না হয়।
লেখকঃ সাংবাদিক


যোগাযোগ

বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যলয়

কাব্যকস সুপার মার্কেট, ৩ ডি কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫।

মোবাইলঃ ০১৬২২৬৪৯৬১২, ০১৬০০০১৪০৪০

মেইলঃ tadantachitra93@gmail.com, tchitranews@gmail.com

সামাজিক যোগাযোগ

Web Design & Developed By
A

তদন্ত চিত্র কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েব সাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি।