TadantaChitra.Com | logo

২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

“টিউটর এর ঈদ”

প্রকাশিত : জুন ০৪, ২০১৯, ১১:৫৩

“টিউটর এর ঈদ”

“লেখকঃ মোঃ ফয়সাল আহমেদ রাজ”

স্যার, আপনি এই ঈদে কি কি কিনেছেন?’

‘এখনো কিছু কিনি নাই৷ তবে ঈদের আগের দিন কিনবো৷’

রফিক ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে৷ তার বাবা একজন সাধারণ কৃষক৷ তাদের টানাটানির সংসার। বাড়ি থেকে টাকা এনে পড়ালেখা করার অবস্হা নেই৷ তাই টিউশন করতে হয়৷ সে বনানীতে একটি টিউশন করে৷ নবম শ্রেনীর ছাত্রী। ছাত্রীর নাম নিলুফার ইয়াসমিন৷ ডাক নাম নিলু৷ তার বাবা একজন বড় ব্যবসায়ী৷ তিনি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মালিক৷ বনানীতে তাদের বিশাল আলিশান বাড়ি আছে৷ বেশ কয়েকটি গাড়িও আছে৷

নিলু রফিককে বলল, ‘স্যার, আমার বাবা আমার জন্য সিঙ্গাপুর থেকে ডায়মন্ডের নেকলেস এনেছেন৷’

‘খুব ভাল৷’

‘দেখবেন স্যার?’

‘না।’

‘দাম কতো জানেন স্যার?’

‘কত?’

‘পাঁচ লক্ষ টাকা৷’

‘এতো টাকা?’

‘হ্যাঁ, স্যার৷’

রফিক বিস্মিত চোখে নিলুকে জিগ্যেস করলো, ‘ঈদের জন্য আর কি কি কিনেছো?’

নিলু বলল, ‘স্যার, আমার জন্য আই ফোন ম্যাক্স কিনতে বলেছি বাবাকে। বাবা আগামীকাল কিনে দিবেন৷’

‘এই মোবাইলের দাম কতো?’

‘এক লাখ ত্রিশ হাজার টাকা৷’

‘একটা মোবাইলের দাম এতো টাকা? সত্যি?’

‘স্যার, কি যে বলেন৷ এক লাখ ত্রিশ হাজার টাকা কি বেশি টাকা নাকি? আমার আম্মু তো লাখ টাকার নিচে কোন শাড়ি-ই কিনে না৷’

নিলুর কথা শুনে রফিক চুপসে গেল৷ নবম শ্রেনীর একজন ছাত্রী বলছে এক লাখ ত্রিশ হাজার টাকা নাকি বেশি টাকা নয়৷ আসলে যাদের অঢেল টাকা-পয়সা আছে, তারা দারিদ্রতার কষ্ট বুঝে না৷ রফিক সারা মাস নিলুকে পড়িয়ে মাত্র আট হাজার টাকা পায়৷ এই টাকা দিয়ে সে সারা মাস চলে৷ তাদের কাছে আট হাজার টাকা খুব-ই অল্প টাকা বটে, তবু নিলুর মা রফিককে মাঝে মাঝে কথা শুনিয়ে দেয়৷ নিলুর একটু রেজাল্ট খারাপ হলেই তিনি রফিককে বলেন, ‘এতো টাকা দিয়ে তোমাকে রেখেছি৷ নিলুর রেজাল্টতো ভাল হচ্ছে না৷ তোমাকে আর কিছু দিন দেখবো, তারপর অন্য টিচার রাখবো৷’
কিছুদিন আগে রফিক অসুস্হ ছিল৷ তিন দিন আসতে পারেনি। নিলুর মা রফিককে বললেন, ‘রফিক, তুমি এতো মিস দিলে নিলুর রেজাল্ট ভাল হবে কি করে?’
রফিক বলল, ‘আন্টি, আমার খুব জ্বর ছিলো, তাই আসতে পারিনি৷’
নিলুর মা উত্তর দিলো, ‘তাহলে আগামী শুক্র-শনিবার পড়িয়ে দিও৷’

‘জ্বি, আন্টি, পড়িয়ে দিবো৷’

রফিকের বাড়ি রাঙামাটি জেলায়৷ ঢাকা থেকে ট্রেনে চট্রগ্রাম, তারপর চট্রগ্রাম থেকে বাসে করে রাঙামাটি যেতে হয়৷ যদিও ঢাকা থেকে সরাসরি রাঙামাটির অনেক বাস আছে৷ ঈদের সময় ঢাকা-চট্রগ্রামের রাস্তায় প্রচুর জ্যাম থাকে, তাই রফিক ট্রেনে যাবে৷

রফিকের ক্যাম্পস বন্ধ হয়েছে অনেকদিন আগে, শুধু টিউশনের জন্যে ঢাকায় পড়ে আছে৷ বাড়ি যেতে তার মনটা আনচান করছে৷

রফিক আগামীকাল রাতে তুর্ণা নিশিতা ট্রেনে চট্রগ্রাম যাবে৷ এই ট্রেনটি রাত এগারোটায় কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ছাড়ে।
রফিক আজ টিউশনে এসে নিলুকে এক ঘন্টা পড়িয়েছে৷ তারপর আগামী এক সাপ্তাহে কি কি হোমওয়ার্ক করতে হবে তা বুঝিয়ে দিলো৷

রফিক নিলুকে জিগ্যেস করলো, ‘ঈদের আর কয়দিন বাকি?’

‘স্যার, মনে হয় তিন দিন৷’

‘আজ মাসের কত তারিখ?’

‘এক তারিখ, স্যার।’

নিলুর মা রফিককে মাসের দুই-তিন তারিখে বেতন দেন৷ তাই সে দুই তারিখ রাতে ট্রেনের টিকেট কেটেছে৷ ঈদের আগে টিউশনের বেতনটা তার খুব-ই দরকার৷ বেতন পেলে সে নিজের জন্য একটি পাঞ্জাবি, মায়ের জন্য একটি শাড়ি ও বাবার জন্য একটি ফতুয়া কিনে বাড়ি যাবে। মা-বাবা খুব খুশি হবে৷

রফিক নিলুকে বলল, ‘তোমার আম্মুকে একটু ডাকতে পারবে?’

নিলু তার মাকে ডেকে আনলেন৷ রফিক নিলুর মাকে দেখেই বলল, ‘আস্সালামু আলাইকুম আন্টি৷ ভাল আছেন?’

‘হ্যাঁ, ভাল৷ রফিক কিছু বলবে?’

‘না মানে, আগামীকাল রাতে বাড়ি যাচ্ছি৷ এক সাপ্তাহের বন্ধ৷ সমস্যা নাই৷ ঈদের পরে নিলুকে বাড়তি পড়িয়ে সিলেবাস শেষ করে দিবো৷’

‘আগামীকাল এসে বেতন নিয়ে যাবে৷’

‘ঠিক আছে আন্টি৷ আগামীকাল আসবো৷’

রফিক খুব খুশি হলো৷ আগামীকাল বেতন পাবে৷ আজ রুমে গিয়েই রফিক সবকিছু গুছিয়ে নিলো৷ আগামীকাল টিউশন থেকে এসে যেন ব্যাগটা কাঁধে নিয়েই নাড়ির টানে মা-বাবার কাছে ছুটে যেতে পারে৷

পরেরদিন বিকাল বেলায় রফিক নিলুকে পড়াতে এলো৷ রফিক নিলুকে পড়াচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তার দৃষ্টি দরজার দিকে, কখন আন্টি আসবে, কখন বেতন দিবে৷ এক ঘন্টা পড়ানোর পর সে নিলুকে জিগ্যেস করলো, ‘তোমার আম্মু কোথায়?’

‘স্যার, আম্মু তো বাসায় নাই৷ শপিং করতে মার্কেটে গেছে৷’

‘কখন আসবে জানো?’

‘না, স্যার৷’

রফিক পকেট থেকে মোবাইল বের করে আন্টিকে ফোন দিলো৷ রফিক বলল, ‘আস্সালামু আলাইকুম, আন্টি।’

‘রফিক, তুমি এসেছো?’

‘জ্বি, আন্টি৷’

‘রফিক, তোমার বেতনটা ঈদের পরে নাও৷ শপিং করে টাকা শেষ করে ফেলেছি৷’

‘আন্টি, আমার টাকাটা খুব দরকার ছিল৷’

নিলুর মা রফিকের মুখের উপর ফোনটি রেখে দিলো৷ রফিকের ভিষণ মন খারাপ হলো৷ সে ভাবতেও পারেনি এমনটি হবে৷ কতো আশা ছিল, ঈদে মা-বাবার জন্য কিছু কিনে দিবে৷ আসলেই যাদের অঢেল আছে, তারা কখনোই দারিদ্র্যতার কষ্ট বুঝে না৷ তাদের কাছে জীবন মানে উপভোগ করা। অন্যদিকে রফিকের কাছে জীবন মানে কোন রকমে বেঁচে থাকা। জীবন মানে সংগ্রাম। সংগ্রাম করে সামনে এগিয়ে চলা৷

নিলু বলল, ‘স্যার, আপনার কি মন খারাপ?’

‘না৷’

নিলু আবার বলল, ‘তাহলে কি শরীর খারাপ?’

‘না৷’

‘স্যার, আপনাকে কেমন যেন অস্হির লাগছে৷’

‘আমার কিছু হয়নি৷’

রফিক নিলুকে পড়িয়ে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলো৷ রফিক তার রুমে গিয়ে কাঁধে ব্যাগ নিলো৷ তারপর সোজা রেল স্টেশনের দিকে রওয়ানা হলো৷ তার চোখে পানি আসছে, যে কোন সময় চোখের জল গড়িয়ে পড়তে পারে৷ সে ভাবছে, বড় লোকেরা লক্ষ লক্ষ টাকা আজেবাজে খরচ করে, অথচ একজন টিউটরের সামান্য টাকা দিতে কষ্ট হয়৷ তারা আমাদের আবেগ কখনোই বুঝবে না৷ রফিককে যে টাকা বেতন দেন, তা হয়তো তাদের এক বেলা খাবারের দাম৷

রফিক ট্রেনে উঠে সিটে বসলো৷ ট্রেনও চলতে শুরু করেছে৷ হঠাৎ মনে হলো মাকে ফোন করা দরকার৷ সে মোবাইলটি পকেট থেকে বের করে দেখলো, মোবাইলে দুটি ম্যাসেজ এসেছে৷

প্রথম ম্যাসেজ- বিকাশ থেকে এসেছে৷ তার একাউন্টে দশ হাজার টাকা এসেছে৷

দ্বিতীয় ম্যাসেজ- নিলু দিয়েছে। স্যার, আমার কাছে কিছু টাকা ছিল। আপনাকে পাঠালাম৷ আমার মা-বাবাকে ক্ষমা করবেন৷ ঈদ মোবারক৷ ভাল থাকবেন স্যার৷


যোগাযোগ

বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যলয়

কাব্যকস সুপার মার্কেট, ৩ ডি কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫।

মোবাইলঃ ০১৬২২৬৪৯৬১২, ০১৬০০০১৪০৪০

মেইলঃ tadantachitra93@gmail.com, tchitranews@gmail.com

সামাজিক যোগাযোগ

Web Design & Developed By
A

তদন্ত চিত্র কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েব সাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি।