TadantaChitra.Com | logo

২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

পুলিশ সোর্সদের যত অপকর্ম-২

প্রকাশিত : মে ৩০, ২০১৮, ০৬:৪২

পুলিশ সোর্সদের যত অপকর্ম-২

লালবাগে ১১ পুলিশের নামে চাঁদা আদায় আইজিপির নামেও চাঁদা * প্রতিবাদ করলেই নির্যাতন মিথ্যা মামলা..

রাজধানীর লালবাগের বিভিন্ন স্পটে ১১ পুলিশ সদস্যের নামে সারা বছর ধরে চাঁদা উঠানো হয়। একজন সহকারী কমিশনার (এসি), একজন পেট্রল ইন্সপেক্টর (পিআই), দুই পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ, থানার পরিদর্শক (অপারেশন), উপকমিশনারের (ডিসি) দুই কনস্টেবল, দুই বডিগার্ড এবং দুই গাড়িচালকের নামে টাকা তোলা হয়।

প্রতিদিন ফুটপাতের প্রতি দোকান থেকে পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তার নামে ২০ টাকা করে ১০০ টাকা ও ডিসির ছয় স্টাফের নামে ২০ টাকা করে ১২০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। তবে ঈদকে সামনে রেখে বৃহস্পতিবার থেকে আইজিপির নামেও আরও ২০ টাকা করে চাঁদা তোলা শুরু হয়েছে।

নয়াবাজার, মিটফোর্ড, বাবুবাজার সেতু, আরমানিটোলা, ইসলামপুর, সদরঘাট এবং বাকল্যান্ড বাঁধসহ পুরান ঢাকার ছোটখাটো ব্যবসায়ী, ফুটপাতের হকার এবং পরিবহন মালিক কেউই চাঁদাবাজির থেকে রেহাই পাচ্ছেন না।

এতে কেউ প্রতিবাদ করলে তার ওপর নেমে আসে নির্যাতনসহ মিথ্যা মামলার খড়গ। এমনকি সাজানো অস্ত্র মামলায় জড়িয়ে প্রতিবাদকারীর জীবন অতিষ্ঠ করে তোলা হয়। পুলিশের সোর্স মেহেদী হাসান কুদ্দুস নিজস্ব লোকজন দিয়ে এই চাঁদা তোলে।

আইজিপির নামে টাকা তোলার আগে সোর্স মেহেদী তার ভাগনে সালামকে দিয়ে দোকানদারদের কাছে খবর পৌঁছে দেয়। ‘এবার একজন পুলিশ কর্মকর্তা বেড়েছে। আইজিপির নামে অতিরিক্ত ২০ টাকা করে চাঁদা দিতে হবে’ এই খবর সবার কাছে পৌঁছার পর ইউনুস মাঝি, শাওন, সালাম বেপারি, পেটপোড়া সাইফুল, লম্বা সাইফুল, মাহাবুব, লম্বা জসিম এবং ফর্সা জসিমসহ ১৫-২০ জন চাঁদাবাজিতে নেমে পড়ে। পুরান ঢাকার ফুটপাতসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে তারা অতিরিক্ত চাঁদা তুলতে শুরু করে। এ খবর আসার পর বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করা হয়।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলার পর শনিবার থেকে আইজিপির নামে চাঁদা তোলা বন্ধ হয়ে যায়। তবে নিয়মিত চাঁদা তোলা বন্ধ হয়নি। এছাড়া আরমানিটোলা ও নয়াবাজার এলাকার শতাধিক ট্রান্সপোর্ট থেকে এসি ও পিআইয়ের নামে সপ্তাহ ও মাসিক ভিত্তিতে টাকা তোলা হচ্ছে।

এসব ট্রান্সপোর্ট থেকে মাসে পাঁচ হাজার টাকা থেকে শুরু করে আট হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হয়। ভেজাল কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা চাঁদা নেয়া হয় বলে স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়।

পুরান ঢাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বিশু মিয়া জানান, চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করায় পুলিশের সোর্সরা তার ওপর নানা ধরনের অত্যাচার-নির্যাতন চালায়। এমনকি তাকে মিথ্যা অস্ত্র মামলায় গ্রেফতারও করায়। ওই মামলায় জামিন পেতে তিনি সর্বস্বান্ত হয়েছেন।

পুলিশের পক্ষে চাঁদাবাজি করে বলে ওদের সাত খুন মাফ। ভুক্তভোগী সোহেল রানা, জাহিদ হাসান মিন্টু ও রুবেল গাজী জানান, প্রতিদিন চাঁদাবাজরা ফুটপাতের হকার, ভাসমান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ভ্যানচালক, ঠেলাওয়ালা, বাস-ট্রাক, হলার-লেগুনা স্ট্যান্ডসহ নকল ওষুধ, পলিথিন ও নকল কসমেটিকস ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দৈনিক ও সাপ্তাহিক চাঁদা নিয়ে থাকে।

বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতুর নিচে অনেক দোকানপাট বসিয়েও সেখান থেকেও মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সোর্সরা। কোতোয়ালি, বংশাল, চকবাজার ও লালবাগ থানার সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করছে এসব সোর্স।

স্থানীয়রা জানান, পুরান ঢাকার পুলিশের বড় সোর্স মেহেদী বড় বড় ইয়াবা চালানের সঙ্গে যুক্ত। পুলিশের সোর্স পরিচয়ে হিমেল, মাইকেল, এরশাদ, সাগর, তুফান, আবদুর রব, আলমগীর, বিল্লাল, বাসেত, আজমল ও তৌহিদ লালবাগ এবং চকবাজারে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে।

তাদের নিয়মিত মাসোয়ারা না দিলে মাদক ব্যবসায়ীদের সমস্যা হয়। টাকা না দিলে তাদের পুলিশে ধরিয়ে দেয়া হয়। তাদের মধ্যে হিমেল, শাওন ও এরশাদ সরাসরি মাদক ব্যবসায় জড়িত। তাদের নামে মাদক ও মারামারির মামলা রয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, কামরাঙ্গীরচরে সোহেল, জালাল, বিল্লাল, কুট্টি, সিডি মিন্টু, আরিফ, আশরাফ, চান্দু, কার্তিক, সেকান্দার, রব, মোটা কাদের ওরফে কালা কাদির, জামাল ওরফে র‌্যাব জামাল এবং শাহাবুদ্দিনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে।

বেশির ভাগ সময়ই তারা মিথ্যা মামলার ভয় দেখিয়ে নিরপরাধ মানুষের কাছ থেকে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছে। কামরাঙ্গীরচরের মাদবর বাজার, রনি মার্কেট, হাজারীবাগের ট্যানারি মোড়, মিতালি রোড এবং লালবাগের কেল্লার মোড়ে তাদের তৎপরতা বেশি। কোতোয়ালি ও সূত্রাপুর থানা এলাকায় জামান, লিটন, শম্ভু, মনোয়ারা, সেলিম, ফেনসি রমজান, ইয়াবা জিলু, কানাই, সামসু, জাহাঙ্গীর, শাকিল, সুজন, মাসুদ, সাব্বির, বাবলু, শফিক ও মুজিবর পুলিশের সোর্স পরিচয়ে অপকর্মে লিপ্ত রয়েছে।

পুরান ঢাকার আকমল খান রোডের বিক্রেতা সালাউদ্দিন  জানান, মেহেদীর লোকজন প্রতিদিন পুলিশের নামে ৮০ টাকা করে নেয়। অন্য একজন ৩০ টাকা করে নেয়। বৃহস্পতিবার থেকে আইজিপির নামে ২০ টাকা করে নেয়া শুরু করে মেহেদীর লোকজন। তবে শনিবার আইজিপির নামে টাকা নেয়া হয়নি। একই ধরনের তথ্য দেন, একই রোডের মনির এবং বাবুবাজার ব্রিজের সিঁড়ির ফল বিক্রেতা বাদশা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যবসায়ী জানান, পুলিশের লালবাগ জোনের এক পদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে মেহেদীর দহরম-মহরম সম্পর্ক। তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা খুব বেশি। ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে মেহেদী যদি বলেন, ‘স্যার আপনার পরনের গেঞ্জিটা খুব সুন্দর।’ তাহলে ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘আপনার পছন্দ হলে এটি নেন। আর আপনারটা আমাকে দেন।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের অন্যতম প্রধান সোর্স মেহেদী বলেন, ‘এসবের সঙ্গে আমি জড়িত নই। পুরান ঢাকায় মেহেদী নামে আরও অনেক লোক আছেন। তাদের কেউ হয়তো এসবের সঙ্গে জড়িত।

এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব-পুলিশের হাতে বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হওয়া মেহেদী রোববার  বলেন, টেলিফোনে কিছু বলতে চাচ্ছি না। দেখা হলে সরাসরি কথা হতে পারে। নিজেকে একটি আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে মেহেদি বলেন,  কর্তৃপক্ষসহ বড় বড় পত্রিকার নামকরা সাংবাদিকদের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে। এদিকে বিষয়টি নিয়ে সোমবার বিকালে পুলিশের লালবাগ জোনের পদস্থ এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পর ওইদিন রাতে মেহেদী  কার্যালয়ে এসে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন।

তিনি জানান, পুরান ঢাকায় তৌহিদ নামে পুলিশের একজন বড় সোর্স আছে। এক সময় আমি তার সঙ্গে কাজ করতাম। পরে নানা কারণে দ্বন্দ্ব তৈরি। এ কারণে তিনি আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় নানা অভিযোগ দিচ্ছেন। সোর্স তৌহিদের নামে বেশ কয়েকটি মামলা ও চার্জশিট আছে বলে মেহেদী হাসান কুদ্দুস জানান।

জানতে চাইলে পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) ইব্রাহিম খান মঙ্গলবার  বলেন, এখানে প্রথাগত কোনো সোর্স নেই। কমিউনিটি পুলিশ সদস্যরা আমাদের তথ্য দেন।

মেহেদীসহ লালবাগ বিভাগের কয়েকজন সোর্সের নাম উল্লেখ করে তাদের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিসি বলেন, মেহেদী একজন চিহ্নিত চাঁদাবাজ। তার বিরুদ্ধে মামলা আছে। নতুন করে তার অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার খবর আমার কাছে ছিল না। আপনার কাছ থেকে শুনলাম। মেহেদী ও তার সহযোগীদের আজই গ্রেফতারের ব্যবস্থা করছি।

পুলিশের লালবাগ বিভাগের এসি বদরুল হাসান বলেন, মেহেদী একজন খারাপ লোক। তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। মারামারি মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি মেহেদী সাংবাদিক পরিচয়ে চলাফেরা করেন।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ফুটপাতে আমরা নিয়মিত অভিযান চালাই। একদিক দিয়ে অভিযান চালালে অন্যদিক দিয়ে হকাররা বসে যায়। তবে এখানে কারও নাম ভাঙিয়ে চাঁদা তোলার সুযোগ নেই। কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তিনি আরও জানান, যেসব সোর্স অপকর্মে লিপ্ত তাদের গ্রেফতার করে নিয়মিত মামলায় চালান দেয়া হচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্ট থানার ওসিরা এসব নিয়ে ভালো বলতে পারবেন।


যোগাযোগ

বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যলয়

কাব্যকস সুপার মার্কেট, ৩ ডি কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫।

মোবাইলঃ ০১৬২২৬৪৯৬১২, ০১৬০০০১৪০৪০

মেইলঃ tadantachitra93@gmail.com, tchitranews@gmail.com

সামাজিক যোগাযোগ

Web Design & Developed By
A

তদন্ত চিত্র কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েব সাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি।