TadantaChitra.Com | logo

২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

জাতীয় এ ক্লান্তিকালে ডা. মাহমুদের সাহসী ভুমিকা

প্রকাশিত : মে ১৫, ২০২০, ১০:০৯

জাতীয় এ ক্লান্তিকালে ডা. মাহমুদের সাহসী ভুমিকা

অলনাইন ডেস্কঃ করোনা রোগীদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোর একটি কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল। শুরু থেকেই করোনা রোগীদের সেবা দিয়ে আসছেন হাসপাতালটির সহকারী রেজিস্ট্রার ও মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক মাহমুদ হোসেন। তার সেই অভিজ্ঞতার কথা তার ভাষ্যমতেই আপনাদের জন্য তুলে ধরা হল।

আমাদের হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম না থাকায় আমরা একটু বিপাকেই ছিলাম। আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে কাজ শুরু করি। আমাদের এখানে সেবা কাঠামো এমন—জরুরি বিভাগে রোগী আসে। করোনার উপসর্গ থাকা প্রায় সব রোগীকেই আমরা ভর্তি করে নিই। স্যাম্পল টেস্ট করিয়ে যাদের নেগেটিভ পাই তাদের ছুটি দিয়ে দিই আর যারা পজিটিভ তাদের কোয়ারেন্টিনে রাখি। বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের গাইডলাইন অনুযায়ী তাদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। প্রথম দিকে রোগীর সংখ্যা পঞ্চাশের আশপাশে ছিল। তাই কেবিনেই জায়গা হয়ে যাচ্ছিল। পরে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকলে ওয়ার্ডে রাখতে হচ্ছিল। এখন যেমন হাসপাতালে রোগী থাকে ২০০ থেকে ৩০০-এর মধ্যে। আমাদের হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা কার্যক্রম বেশ গোছাল। ডায়াবেটিস, কিডনি কিংবা হার্টের সমস্যার মতো যাদের অন্যান্য সমস্যা নেই করোনায় তাদের সেরে ওঠার হার ৯২ থেকে ৯৫ শতাংশ।

কাজের মধ্যেই থাকতে চেয়েছি

প্রথম দিকে আমরা যেসব তথ্য পাচ্ছিলাম, তাতে সবার মধ্যেই ভয় ছড়িয়ে পড়েছিল। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামও তখন পর্যাপ্ত ছিল না। আমাদের টিম লিডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল (আহমেদ) স্যারের পরামর্শ ও আন্তরিকতায় ভয় থেকে আমরা অনেকটাই মুক্ত হই। আমাদের ছিল সাত দিন ডিউটি। ১৪ দিন কোয়ারেন্টিন। তারপর সাত দিন বিশ্রাম শেষে কাজ। পরে সরকার একটা নির্দেশনা জারি করল—১০ দিন কাজ। ১৪ দিন কোয়ারেন্টিন আর ছয় দিন পরিবারের সঙ্গে। এখন সেভাবেই চলছে। আমি সব সময় কাজের মধ্যে থাকতে চেয়েছি। করোনা রোগীরা সামাজিকভাবে যে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছিলেন—লাশ কবরে রাখারও লোক পাওয়া যাচ্ছিল না, ছেলে-মেয়েরা তাদের মা-বাবাকে ফেলে চলে যাচ্ছে—এসব দেখেশুনে আমার সত্যি খুব খারাপ লেগেছিল। তাই আমি কাজ করতে চেয়েছি। পরিবারের পক্ষ থেকেও কোনো বাধা আসেনি।

এপ্রিলের প্রথম দিন

সম্ভবত মার্চের ২৪ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত একটা ব্যাচ কাজ করে গেছে। তারপর এলো আমার পালা। আগেই খোঁজখবর নিলাম। ‘টাস্কফোর্স কভিড’ নামে মেসেঞ্জারে একটা গ্রুপ আছে আমাদের। সেখানে আমরা যার যার সমস্যা, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি শেয়ার করি। সেখান থেকে আপডেট নিলাম, টেলিফোনে সবার সঙ্গে আলাপ করলাম, কী অবস্থা, কেমন হচ্ছে ইত্যাদি। সহকর্মীরা জানাল—রেগুলার রোগী আসছে, তাদের কেউ কেউ মারা যাচ্ছে। তখন ঠিক নার্ভাস নয়, নিজের সুরক্ষার ব্যাপারে একটু সচেতন হলাম—কিভাবে রোগীও সেবা পাবে, আমিও সুরক্ষিত থাকব।

সে রাতে ঘুমাতে পারিনি

আমাদের ৫০০ বেডের জেনারেল হাসপাতাল। স্বাভাবিক সময়ে এখানে দিনে গড়ে পাঁচ-ছয় হাজার রোগী আসে আউটডোরে। ৭০০-৮০০ রোগী ভর্তি থাকে। সারা দিন একটা গমগম অবস্থা থাকে। কিন্তু ১ এপ্রিল একেবারেই অচেনা একটা পরিবেশ। মনে হলো যেন শ্মশানপুরীতে এসে পড়েছি। বাইরে রোগী নেই, মানুষের ভিড়ভাট্টা নেই। মানুষের এই দুর্যোগে প্রকৃতিও মনে হলো নীরবতা পালন করছে। যাহোক, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে ডিউটি শুরু করলাম। শুরুর দিকের একটা ঘটনা এখনো ভুলতে পারিনি। নারায়ণগঞ্জের ক্লাস্টার এরিয়া থেকে এক ভদ্রলোক এসেছেন। বেশ কয়েক দিন ধরে জ্বরে ভুগছিলেন। কেবিনে ছিলেন। আমি রাউন্ডে বের হলে একজন কেউ বলেছিলেন, ওই পেশেন্টের অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত গেলাম। ততক্ষণে তিনি মারা গেছেন। উনার বেডের সামনে গিয়ে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। লোকটার স্ত্রী খুব জোরে জোরে কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, ‘আই ক্যান নট লিভ উইদাউট ইউ।’ তখন রোগীর খুব নিকট সংস্পর্শে যাই, তার চোখ দেখি, শ্বাস-প্রশ্বাস যাচাই করি, বুকে স্টেথো দিয়ে দেখি হৃত্স্পন্দন আছে কি না। কারণ যতই বিচলিত হই না কেন, আমাকেই তো রোগীকে ডেড ডিক্লেয়ার করতে হবে, তার আগে নিশ্চিত হতে হবে।

বাবার সেবা করতে পারব না?

আরেকজন ছিলেন অন্য একটা হাসপাতালে ভর্তি। করোনা পজিটিভ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে এখানে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। তাঁর বেশ কয়েকটি রোগ। ভদ্রলোককে তাঁর মেয়ে সেবাযত্ন করছে। মেয়েরও করোনা পজিটিভ হয়ে গেছে। মেয়েটা বলছিল, ‘স্যার, আমারও তো পজিটিভ। এখন তো আমাকে অন্য ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেবে। তাহলে আমি বাবার সেবা করব কিভাবে?’ শুনে ভেতরটা নাড়া দিয়ে উঠল। বললাম, ‘আচ্ছা তুমি এখানেই থাকো। আমি তোমার চিকিৎসা করব।’ কিন্তু হাসপাতালের নিয়ম হলো, রেজিস্টার বুকে রোগীর নাম না ওঠালে ওষুধগুলো পাওয়া যাবে না। তখন সে বলল, ‘স্যার, আমাকে তো এখান থেকে ওষুধ দেবে না।’ এর মধ্যে এক ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। বললেন, ‘ঠিক আছে মা, স্যার লিখে দিক। আমি তোমার ওষুধ আনার ব্যবস্থা করব।’ শুনে মন ভালো হয়ে গেল।

আমি তো ভালো হয়ে গেছি

এখন অবশ্য সুখকর স্মৃতিই বেশি জমা হচ্ছে। সেদিন যেমন সার্জারি ওয়ার্ডে রাউন্ড দিচ্ছিলাম। এক ভদ্রলোক পাশ থেকে এসে পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন। বললেন, ‘স্যার, ভালো হয়ে গেছি, কাল চলে যাব। আমি মানসিকভাবে খুব চাঙ্গা আছি। দোয়া কইরেন।’

এ পর্যন্ত প্রায় ৩০০ জনের মতো করোনা রোগীর সেবা দিয়েছি। পালস অক্সিমিটার নামে একটা যন্ত্র দিয়ে প্রত্যেক রোগীর অক্সিজেন চেক করি। তাদের আশ্বস্ত করি, ঘাবড়ানোর কিছু নেই, আমরা তো আছি। করোনায় রোগীদের একধরনের সাইকোলজিক্যাল ব্রেক ডাউন হয়। ধরুন, ওয়ার্ডে একজন কেউ সেরে উঠলে তাকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পাশের বিছানার রোগীর চোখে-মুখে তখন এক ধরনের বন্দিদশা ফুটে ওঠে। কারণ চাইলেও তিনি যেতে পারছেন না। তাঁদের হৃদয়ে একধরনের হাহাকার কাজ করে। আমরা তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়াই। কথা বলি। সমস্যাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনি। সাহস জোগানোর চেষ্টা করি। সেদিন যেমন একজন রোগী অনেক কিছু বলতে চাইছিলেন। মনোযোগ সহকারে তাঁর কথা শোনার পর বললাম, আপনি মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছেন, এসব ভুলে যান, চিন্তা করবেন না। ঠিক হয়ে যাবে। তারপর অন্য রোগী দেখতে যাব, উনি আবার পেছনে এসে বললেন, স্যার, আমার জিহ্বাটা কালো হয়ে গেছে। আবারও আশ্বস্ত করলাম লোকটাকে। এভাবেই চলছে।

বাবা, তুমি কোথায়?

হাসপাতাল থেকে সরাসরি বারিধারার বাসায় চলে আসি। আলাদা রুমে থাকি। খাওয়ার সময় ছেলে প্লেটভর্তি খাবার এনে দরজার বাইরে রাখে। আমি ভেতরে নিয়ে আসি। খাওয়া শেষে থালা পরিষ্কার করে আবার দরজার বাইরে রাখি। আমার ছোট ছেলেটার বয়স ১৫। আগে একই টেবিলে বসে ইফতার করতাম। মন চাইলেও এখন পারি না। সেদিন ছোট ছেলেটা বুঝি বেখেয়ালেই ডেকে বলেছিল, ‘বাবা, তাড়াতাড়ি আসো, ইফতারের টাইম হয়ে গেল তো।’ আগে রমজান মাসে আমরা সাহরি খেয়েই ঘুমাতে যেতাম। বাপ-ছেলে মিলে জেগে থাকতাম। একসঙ্গে টিভি দেখতাম। অনেক সময় ওরা হয়তো গেমসটেমস খেলত। নানা বিষয় নিয়ে আলাপ হতো। এটা এবার খুব মিস করছি। আগে ডিউটি দিয়ে যখন ফিরতাম তখন ছেলেটা জড়িয়ে ধরত। কোনো দিন একটু দেরি হলে বলত, বাবা, তোমার ফিরতে এত দেরি হলো কেন? অ্যানি প্রবলেম?’ এখন মন চাইলেও বাসায় ফেরার পর ছেলের মাথায় হাত রাখতে পারি না। তবে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পথে মানুষের মুখে যে ভুবনজয়ী হাসি দেখি তাতে এসব ভুলে থাকা যায়।


যোগাযোগ

বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যলয়

কাব্যকস সুপার মার্কেট, ৩ ডি কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫।

মোবাইলঃ ০১৬২২৬৪৯৬১২, ০১৬০০০১৪০৪০

মেইলঃ tadantachitra93@gmail.com, tchitranews@gmail.com

সামাজিক যোগাযোগ

Web Design & Developed By
A

তদন্ত চিত্র কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েব সাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি।