TadantaChitra.Com | logo

২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ৩রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

হোসেনের রাজত্বে দখল, চাঁদাবাজি করেই কোটিপতি!

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৮, ২০১৯, ১৬:৩৫

হোসেনের রাজত্বে দখল, চাঁদাবাজি করেই কোটিপতি!

এলাকায় জমি দখল, চাঁদাবাজিসহ হেন অপকর্ম নেই যা করেন, হোসেনের রাজত্বে কামরাঙ্গীরচর, সাধারণ মানুষের জমি, খাসজমি, নদীর তীর, খেয়াঘাট, ট্রলারঘাট, রাস্তা, ফুটপাত, মার্কেট এলাকার সবই ‘হোসেন বাহিনীর’ দখলে ডিশ-ইন্টারনেটের ব্যবসাও তাদের নিয়ন্ত্রণে হোসেনের রয়েছে বিশাল ক্যাডার বাহিনী দারোগাকে মারধর,পদ না দেওয়ায় আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ি হামলা! 

বিশেষ প্রতিবেদকঃ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা, পুলিশ বা সাধারণ মানুষ রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের কারও রেহাই নেই ‘হোসেন বাহিনীর’ হাত থেকে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেনের রয়েছে ‘বিশাল ক্যাডার বাহিনী’। আওয়ামী লীগ নেতা, পুলিশ ও এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এ অভিযোগ পাওয়া গেছে। তারা বলছেন, সাধারণ মানুষের জমি, খাসজমি, নদীর তীর, খেয়াঘাট, ট্রলারঘাট, রাস্তা, ফুটপাত, মার্কেট এলাকার সবই ‘হোসেন বাহিনীর’ দখলে। ডিশ-ইন্টারনেটের ব্যবসাও তাদের নিয়ন্ত্রণে। তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে মোহাম্মদ হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একাদশ সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-২ আসনে সাবেক খাদ্যমন্ত্রী

অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের পক্ষে কাজ করায় প্রতিপক্ষ শাহীন চেয়ারম্যানের অনুসারীরা আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।’

আওয়ামী লীগের স্থানীয় এক নেতা  বলেন, হোসেন ও তার লোকজনের ভয়ে এলাকার কেউই মুখ খোলার সাহস পান না। অথচ হোসেন থানা আওয়ামী লীগের ২৪ নম্বর সদস্য। তিনি এলাকায় জমি দখল, চাঁদাবাজিসহ হেন অপকর্ম নেই যা করেন না। থানা ছাত্রলীগের সাবেক আহবায়ক বিপ্লবের নেতৃত্বে হোসেনের রয়েছে বিশাল ক্যাডার বাহিনী। চাঁদাবাজি ও দখলবাজির মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থের বড় অংশ থাকে তার ক্যাশিয়ার আশ্রাফাবাদের খোকন ওরফে ওয়াল্টন খোকনের কাছে। এলাকার ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশা থেকে ১ হাজার টাকা করে প্রতি মাসে হোসেনের লোকজনের আয় কোটি টাকা।

হোসেনের উত্থান সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, একসময় বিএনপি নেতা নাসিরউদ্দিন আহম্মেদ পিন্টুর ক্যাডার হোসেন কাউন্সিলর হওয়ার আগেও কামরাঙ্গীরচরে একটি টিনশেড বাড়িতে থাকতেন। তার শ্বশুর বিএনপি নেতা রফিক ওরফে বানচাল রফিক এলাকায় পিন্টুর ক্যাডার হিসেবে পরিচিত। তার কারণেই চারদলীয় জোট সরকারের আমলে হোসেনের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। পরে ক্ষমতার পট-পরিবর্তনে ছাত্রলীগে যোগ দেন তিনি। কাউন্সিলর হওয়ার পর হোসেনের অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। তিনি কামরাঙ্গীরচরের হুজুরপাড়া নূরজাহান স্কুলের সামনে ১০ কাঠা জমিতে বিলাসবহুল বাড়ি করেছেন। এছাড়া আশ্রাফাবাদ দশআনী বাজারে সাত কাঠা জমি, ইসলামনগর মদিনাবাগ মসজিদের সামনে ছয়তলা বাড়িসহ বিপুল সম্পত্তির মালিক।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা জানান, নয়াগাঁও এলাকার পারভেজ হোসেন বিপ্লব ও শিমুল, পোড়াঘাটের সজীব, ব্যাটারিঘাটের কবির ও সুমন, ইসলামনগরের মাউড়া ইসমাইল, টেকেরহাটির ময়লা জয়নাল, পূর্ব রসুলপুরের ইয়াবা সিরাজ, পশ্চিম রসুলপুরের মসিউরসহ অনেকে হোসেনের ‘বড় ক্যাডার’ হিসেবে পরিচিত। তাদের মাধ্যমে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও দখলদারি চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

এলাকাবাসী জানায়, হোসেন কাউন্সিলর হওয়ার পর ২০১৪ সালে বিপ্লবকে নিয়ে থানা যুবদলের সাবেক সভাপতি নাঈমের ডিশলাইনের ব্যবসা দখল করে নেয়। এছাড়া আশ্রাফাবাদ খালপাড়, আলীনগর, টেকেরহাটি, রসুলপুরসহ এলাকার সব অটোস্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণ করে বিপ্লব ও তার লোকজন। হোসেনের অন্য ক্যাডার মো. ইসমাইল হোসেন ওরফে মাউরা ইসমাইল এলাকায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেওয়ার হোতা। আর চোরাই বিদ্যুৎ সংযোগ, জেনারেটর ব্যবসার নামে অন্য এলাকার লাইনের বিদ্যুৎ ব্যবহার, অটোরিকশা-অটোবাইক চার্জার কারখানা নিয়ন্ত্রণ করেন পচা সিদ্দিক ও কবীর সুমন। হোসেনের সঙ্গে দেহরক্ষীর মতো সবসময় থাকেন বিপ্লব, ইয়াবা সিরাজ, আবদুল বাতেন, মুসা, রনি ও শিমুলসহ ১৫-২০ জন।

 

দারোগাকে মারধর : ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে চাঁন মসজিদ এলাকায় দায়িত্ব পালন করছিলেন দারোগা আবদুল মোতালেব। তিনি ‘অন-টেস্ট’ লেখা একটি মোটরসাইকেল আটক করেন। এর কিছুক্ষণ পর কাউন্সিলর হোসেনের নেতৃত্বে রনি মার্কেটের মাহবুবুল আলম রনি, আশিক বাবু, সাহাবুদ্দিনসহ ২০-২৫ যুবক কয়েকটি মোটরসাইকেলে ঝাউলাহাটীতে মোতালেবের ওপর হামলা চালায়। কিল, ঘুষি, লাথি মারার একপর্যায়ে তার ইউনিফর্ম ছিঁড়ে নেওয়ার পাশাপাশি বাঁশি ছিনিয়ে নিয়ে উল্লাস করতে থাকে তারা। খবর পেয়ে এএসআই রায়হানসহ অতিরিক্ত পুলিশ হামলাকারীদের কবল থেকে মোতালেবকে উদ্ধার করে। ওই ঘটনায় এসআই মোতালেব জিডি করে ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষকে অবহিত করেও কোনো বিচার পাননি।

 

পদ না দেওয়ায় হামলা : আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন, কামরাঙ্গীরচর থানা ও ওয়ার্ড কমিটিতে নিজের ও পছন্দের লোকেরা কাক্সিক্ষত পদ না পাওয়ায় গত বছর আগস্টে কামরাঙ্গীরচরে দলের পাঁচ নেতার বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে ‘হোসেন বাহিনী’। যাদের বাড়িতে হামলা হয় তারা হলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য মোশারফ হোসেন খান, কামরাঙ্গীরচর থানার যুগ্ম সম্পাদক আবুল হাসান, ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক হাজি জামাল দেওয়ান, একই ওয়ার্ডের এক নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান হাওলাদার ও এক নম্বর সাংগঠনিক সম্পাদক রমজান দেওয়ান বাবু। তারা ওই সময় ছয়টি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়। এছাড়া গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হোসেন সরকারের স্ত্রী ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর শিউলি হোসেন সরকারের কার্যালয়।

আবুল হোসেন সরকার  বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা যেমন তাণ্ডব চালিয়েছে, ঠিক সেভাবে হামলা চালিয়েছে হোসেনের লোকজন। এর কোনো বিচার পাইনি। আমাদের সাধারণ সম্পাদক চিকিৎসার জন্য যখন দেশের বাইরে ছিলেন তখন তার ছবিতে জুতার মালা পরিয়ে এলাকায় মিছিল করেছে তারা। তারও বিচার হয়নি।’

নেতাদের মারধর : কাউন্সিলর হোসেনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন নেতাকে মারধরের অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয়রা জানায়, কিছুদিন আগে কামরাঙ্গীরচর থানা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি আনোয়ার হোসেনকে ওসির সামনেই মারধর করেন হোসেনের ক্যাডার বিপ্লব। পরে আনোয়ার দুঃখ করে বলেন, ৩৫ বছর আওয়ামী লীগ করে শেষ বয়সে ছাত্রলীগ নেতার হাতে মার খেতে হলো। এছাড়া কামরাঙ্গীরচরের বড়গ্রাম বাজারের মৎস্যজীবী শ্রমিক লীগ নেতা ইউনুস মিয়াকে স্থানীয় এমপির বাড়িতে ডেকে মারধর করেন হোসেন। চাঁদা না দেওয়ায় গত মার্চে জাউলাহাতির হযরতনগরে আমজাদ হোসেন সোহাগ ও যুবলীগ নেতা মো. জাহিদকে মারধর করে তার লোকজন। তাছাড়া হোসেন বাহিনীর মারধরের শিকার ৫৫ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন শাকিল ও ব্যবসায়ী সারোয়ার হোসেন সাকিবের নামে উল্টো ভাঙচুর ও লুটপাটের মামলা করা হয়।

ঘাট দখল : স্থানীয়দের অভিযোগ, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্র্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কাছ থেকে বুড়িগঙ্গা নদীর হুজুরপাড়া ঘাটের ইজারা নেন ইউসুফ। ঘাটে ওঠা টাকার অর্ধেক দিতে রাজি না হওয়ায় তিন দিনের মাথায় সেটি দখল করে হোসেন বাহিনী। আওয়ামী লীগের এক কর্মী বলেন, মাদবরবাজার থেকে বাবুবাজার ট্রলারঘাটের ইজারা পান থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সোলেমান মাতবর। গত সেপ্টেম্বরে তিনি চিকিৎসার জন্য ভারতে গেলে হোসেনের লোকজন ঘাটটি বন্ধ করে দেয়

হোল্ডিং প্লেটের নামে কোটি টাকা : কামরাঙ্গীরচরের তিনটি ওয়ার্ডে ২৫ হাজারেরও বেশি বাড়ি রয়েছে। হোল্ডিং প্লেট দেওয়ার নামে এলাকার অধিকাংশ বাড়ি থেকেই ৪০০-৫০০ টাকা করে আদায় করে ‘হোসেন বাহিনী’। এলাকাবাসীর অভিযোগ, এভাবে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও অনেক বাড়িতেই নম্বর প্লেট দেওয়া হয়নি।

বাড়ির সামনে ময়লা ফেলে শায়েস্তা : কথা কাটাকাটির জের ধরে গত মে মাসে চেয়ারম্যানবাড়ী এলাকায় থানা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জসীমের বাড়ির সামনে ট্রাকভর্তি ময়লা রেখে যায় হোসেনের লোকজন। স্থানীয় এক বাসিন্দা মোবাইল ফোনে এর ছবিও দেখান।

বুড়িগঙ্গার তীর দখল : গত ফেব্রæয়ারিতে কামরাঙ্গীরচর কুড়াঘাট এলাকায় অভিযান চালিয়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে বিআইডবিøউটিএ। এলাকাবাসীর ভাষ্য, তিন মাসের মাথায় সেই জায়গা আবারও দখল করে নেয় হোসেনের লোকজন। পরে কুড়াঘাট ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের পাশে বসানো হয় মেলা।

কাউন্সিলর হোসেনের বক্তব্য : এসব অভিযোগ অস্বীকার করে কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘স্থানীয় এমপি কামরুল ইসলাম এ এলাকার অনেক উন্নয়ন করেছেন। আমি বিগত নির্বাচনে তার পক্ষে ছিলাম। অথচ স্থানীয় নেতাদের কেউ কেউ কেরানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন আহম্মেদের পক্ষ নিয়ে আমার বিরোধিতা করছে। তারাই বিভিন্ন মহলে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার ছড়াচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রায় ১৭ বছর ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছি। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ থাকায় কামরাঙ্গীরচর থানার নেতাদের যোগসাজশ ও ষড়যন্ত্র করে আমাকে করা হয়েছে থানা আওয়ামী লীগের ২৪ নম্বর সদস্য। অথচ আমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পলিটিক্যাল সায়েন্সে অনার্স-মাস্টার্স করেছি। আমারও কিছু শুভাকাক্সক্ষী আছে। তারা হয়তো ক্ষুব্ধ হয়ে কিছু ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে।’

জসীমের বাড়ির সামনে ময়লা ফেলা প্রসঙ্গে হোসেন বলেন, ‘জসীম ও তার বাবা পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের মারধর করেন। তাই ঠিকাদার ময়লা ফেলেছে। আমি তো আর ময়লা ফেলি নাই বরং সমস্যা হওয়ার পর সমাধান করে দিয়েছি।’ বাসাবাড়ির নম্বর প্লেটের নামে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘চাঁদা আমি তুলিনি। ওই চাঁদা তুলেছে কালু দেওয়ান।’ ঘাটদখলের অভিযোগও ঠিক নয় বলে দাবি করেন তিনি।

থানায় ওসির সামনে আওয়ামী লীগ নেতাকে মারধর প্রসঙ্গে হোসেন বলেন, ‘ওইদিন থানায় থাকলেও আমি মারধরের সময় উপস্থিত ছিলাম না।’


যোগাযোগ

বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যলয়

কাব্যকস সুপার মার্কেট, ৩ ডি কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫।

মোবাইলঃ ০১৬২২৬৪৯৬১২, ০১৬০০০১৪০৪০

মেইলঃ tadantachitra93@gmail.com, tchitranews@gmail.com

সামাজিক যোগাযোগ

Web Design & Developed By
A

তদন্ত চিত্র কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েব সাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি।