TadantaChitra.Com | logo

১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

করোনা রূপ বদলে জটিল হচ্ছে! 

প্রকাশিত : মে ০২, ২০২০, ১১:৪১

করোনা রূপ বদলে জটিল হচ্ছে! 

অনলাইন ডেস্কঃ দেশে করোনাভাইরাস ক্রমেই জটিল হচ্ছে। বারবার জৈবিক পরিবর্তনের ফলে বদলে যাচ্ছে ভাইরাসটির চরিত্র। এসব পরিবর্তনের কারণে রোগটির উপসর্গেও বেশকিছু পরিবর্তন আসছে। শুরুর দিকে করোনা রোগীর শরীরে যেসব ও যে সময়ের মধ্যে উপসর্গ দেখা দিত, এখন সেখানে নতুন উপসর্গ যুক্ত হচ্ছে। রোগ শনাক্ত করে চিকিৎসা দিতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে চিকিৎসকদের। এর ফলে একদিকে যেমন রোগটি কমিউনিটিতে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ছে, তেমনি আক্রান্তদের দুর্ভোগ বাড়ছে।

দেশের রোগতত্ত্ববিদরা বলছেন, গত দুই সপ্তাহ ধরে দেশে উপসর্গহীন করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। আবার এমনও রোগী পাওয়া যাচ্ছে যাদের শরীরে করোনার সব ধরনের উপসর্গ রয়েছে কিন্তু তিনি করোনা আক্রান্ত নন। গাইবান্ধায় দ্বিতীয়বার করোনা আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। এছাড়া এমন কিছু রোগী মিলছে যাদের জ্বর, সর্দি ও কাশি হয় না ঠিকই, তবে তাদের স্বাদ এবং গন্ধ বোঝার ক্ষমতা ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে। এমনকি হজমে সমস্যা হচ্ছে। ডায়রিয়া দেখা দিচ্ছে।

মাথা ও কিডনিতে রক্ত জমাট বেঁধে স্ট্রোক হচ্ছে। করোনা থেকে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বিশেষ করে উপসর্গহীন করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলে জানান সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া।

তিনি বলেন, আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালসহ আরও কয়েকটি সরকারি জেনারেল হাসপাতালের পরিসংখ্যান নিয়ে দেখেছি, এসব হাসপাতালে যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের ৯০ শতাংশের মধ্যে করোনার কোনো উপসর্গ নেই। তার মানে দেশে যে ২৫-৩০ শতাংশ উপসর্গহীন করোনা রোগী পাওয়া যাচ্ছে, কমিউনিটি ও হাসপাতালে সে সংখ্যা বাড়ছে।

এ চিকিৎসক বলেন, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গতকাল পর্যন্ত ৫৭ জন চিকিৎসক ও নার্সসহ বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে চিকিৎসক ৪০, নার্স ৭ ও ১০ জন টেকনোলজিস্ট। ৪০ জন চিকিৎসকের মধ্যে দুয়েকজন বাদে অন্যদের মধ্যে কোনো উপসর্গ নেই। যে সাতজন সিস্টার আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের মধ্যে একজনের উপসর্গ পাওয়া গেছে, বাকিদের নেই। কর্মচারীদের এক-দুজন ছাড়া কারোরই উপসর্গ নেই। এভাবে যদি ৯০ শতাংশ রোগীই উপসর্গ ছাড়া আসে, তাহলে তো মারাত্মক।

এমনটা কেন হচ্ছে জানতে চাইলে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, এ ভাইরাসটা হলো করোনা গ্রুপের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল ভাইরাস। এটাই এর শক্তি। বাংলাদেশেই শুধু নয়, ভারতেও শতকরা ৮০ ভাগ লোকের মধ্যে কোনো উপসর্গ দেখা যায় না।

কিন্তু যখন টেস্ট করে তখন করোনা পজিটিভ আসে। এটা আমরা বাংলাদেশেও পাচ্ছি। কারণ দুর্বল ভাইরাসের প্রকৃতিই হচ্ছে আপনার যদি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে, আপনি যদি ভালো খান, ব্যায়াম করেন, এ ধরনের মানুষের মধ্যে বেশিরভাগই উপসর্গবিহীন আসে। এ সংখ্যাটা অনেক বড়।

এ বিশেষজ্ঞ বলেন, করোনা ভাইরাসের যে রিসিপ্টার ফুসফুসে আছে, তেমনি খাদ্যনালিতেও আছে। ওখানে যদি সংক্রমণ হয় তাহলে ডায়রিয়া হতে পারে। করোনার তিন ধরনের উপসর্গ একটা হলো কোনো উপসর্গ দেখা যাবে না কিন্তু পজিটিভ, অনেকটাই ক্যারিয়ারের মতো, বহনকারী বলা চলে। আরেকটি হলো মাইল্ড। সামান্য একটু সর্দিকাশি হলো, একটু জ্বর জ্বর হবে, দু-তিন দিন থাকবে, ভালো হয়ে যাবে। আরেক ধরনের উপসর্গ হলো নিউমোনিয়া পর্যন্ত যাবে। এটাই সবচেয়ে মারাত্মক। এ ধরনের রোগীদের ক্ষেত্রেই অক্সিজেন লাগে।

তিনি বলেন, আমাদের দেশে করোনার শতকরা ৮০ জনের কিন্তু বাসায় গরম পানি ও ভিটমানি ‘সি’ খেলেই ভালো হয়ে যায়। তারপর যে ২০ শতাংশ, তাদের মধ্যে ১৫ শতাংশের ডাক্তারের কাছে যেতে হতেও পারে, নাও হতে পারে। ডাক্তারের থেকে ফোনে ওষুধ নিলেন, ভালোমতো খাওয়া-দাওয়া করলেই ভালো হয়ে যান।

আর ৫ শতাংশের মধ্যে ২-৩ শতাংশের হাসপাতালে যেতে হয় ও ভেন্টিলেটরে ডাক্তারের অবজারভেশনে থাকলেই ভালো হয়ে যায়। কিন্তু ১-২ শতাংশ মানুষের জন্য এটা মারাত্মক হয়ে দাঁড়ায়। এসব মানুষের অন্যান্য রোগ থাকে, বিশেষ করে যেমন ডায়বেটিস, হার্টের রোগী, ক্যানসার, যাদের কেমোথেরাপি চলছে, কিডনির রোগী বা বেশ বয়স্ক মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে।

এশিয়ায় আসার পর ভাইরাসটির কেমন পরিবর্তন হয়েছে জানতে চাইলে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, বাংলাদেশেরটা আমরা এখনো বিশ্লেষণ করিনি। তবে এশিয়াতে ভাইরাসটির যে পরিবর্তন হয়েছে, তাকে আমরা তিনটি ভাগে ভাগ করি। ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ ক্লেড। ‘এ’ ক্লেডের ভাইরাস ঘোড়ামুখী বাদুড় থেকে এসেছে। চীনে যখন মানুষের মধ্যে এলো এবং মানুষ থেকে মানুষে ছড়ানোর ক্ষমতা অর্জন করল, সেটাকে বলা হয় ‘বি’ ক্লেড।

এ অংশটাই আমাদের এখানে এশিয়াতে বেশি ছড়াচ্ছে। ‘বি’টা আবার ইউরোপে গিয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করল, খুব অ্যাগ্রেসিভ, সেটা ‘সি’ ক্লেড ভাইরাস। এ তিন শ্রেণির মধ্যে ‘বি’ ক্লেডটা দুর্বল। কারণ আমরা যেভাবে হঠাৎ হঠাৎ গার্মেন্টস খুলে দিচ্ছি, লকডাউন মানছি না, সামাজিক দূরত্ব লঙ্ঘন হচ্ছে, জানাজা পড়তে গিয়ে লাখ মানুষ হয়ে যাচ্ছি, তারপরও কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের এখানে প্রাদুর্ভাব অতখানি না। এটার কারণ হলো ‘বি’ ক্লেডের ভাইরাসটা একটু কম ইনফেকশন। তবে ‘সি’টা মারাত্মক ইনফেকশন।

এ গবেষক জানান, করোনার জীনগত পরিবর্তন নিয়ে ভারতে কিছু গবেষণা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, ভাইরাসটির জীবনতত্ত্বে কিছু বদল এসেছে। তবে তা দিয়ে চরিত্রের খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। তিনি বলেন, আমি ৩০ মার্চ পর্যন্ত গোটা বিশ্বে ভাইরাসটির রূপ নিয়ে একটি বিশ্লেষণ করেছি।

তাতে দেখা গেছে, ভাইরাসটা ১ হাজার ৪০২টা পরিবর্তন করেছে। তার মধ্যে প্রোটিনে ৭২২টা পরিবর্তন হয়েছে (এখানে পরিবর্তন হলে আসল চরিত্র বদল হয়)। তবে এ পরিবর্তনের প্রভাব বা ফল কী হয়েছে, সেটা বিশ্লেষণ করা হয়নি।

সারা বিশ্বের ২ হাজার ৫০০ সিকোয়েন্স (জীবন রহস্য) বিশ্লেষণ করেছি। তাতে দেখা গেছে, ক্লেড ‘বি’র এক ধরনের পরিবর্তন হয়েছে, ‘সি’র আরেক ধরনের। এতে দেখা গেছে, ‘সি’তে যে পরিবর্তন, তার জিনে কিছু ভেঙে গেছে, সেসব কারণে ওই টাইপের ভাইরাসটা বেশি মারাত্মক রূপ নিয়েছে।

এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ধারণা করা হচ্ছে ভাইরাসটি মিউটেশনের মাধ্যমে তার চরিত্র বদল করেছে। তবে ঠিক কতবার এ ধরনের বদল এসেছে, সেটা এখনো জানা যায়নি। কারণ আমাদের এখানে এখনো কোনো ল্যাবরেটরি গবেষণা হয়নি।

তবে ধারণা করছি মিউটেশন হয়ে, ভাইরাসের প্রকৃতি পরিবর্তন হয়ে এসব হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ভাইরাস স্টেন পাল্টালে মূলত দুটি সমস্যা তৈরি হয়। প্রথমত, ভাইরাস প্রতিরোধে ভ্যাকসিন স্টেন অনুযায়ী তৈরি হয়। তাই ভাইরাস যদি স্টেন পাল্টে ফেলে তাহলে ওই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়।

দ্বিতীয়ত, ভাইরাসের একটি স্টেনে কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হলে তার শরীরে ওই স্টেনের বিপরীতে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। সে ভাইরাসের ওই স্টেনে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হয় না। কিন্তু স্টেন পাল্টালে আক্রান্ত ব্যক্তির ফের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে স্টেন পরিবর্তনের এ তথ্য চিন্তার বিষয়।

এ মিউটেশনের কারণে দুটি জিনিস হতে পারে একটা হলো এ রোগটা মাইল্ড হয়ে যেতে পারে, আবার স্ট্রং হতে পারে। এ পরিবর্তনের কারণে রোগটির উপসর্গ বদল হতে পারে। এমন প্রেক্ষাপটে করোনা নিয়ন্ত্রণে করোনা পরীক্ষা বাড়াতে হবে পরামর্শ দিয়ে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, অনেক পরীক্ষা করতে হবে। এখন যা করছি সেটা বেশি না। প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ হাজার পরীক্ষা করা দরকার।

ল্যাবের ক্ষমতা আছে। যারা ল্যাবে কাজ করছেন, তাদের আরও বেশি প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আমরা এখনো খবর পাচ্ছি যারা ল্যাবে কাজ করছেন তারা সংক্রমিত হয়ে যাচ্ছেন। এটা খুবই দুঃখের বিষয়। একজন সিনিয়র অধ্যাপক সংক্রমিত হয়েছেন। সুতরাং ল্যাবের সুরক্ষা ব্যবস্থা বাড়াতে হবে।

অনুরূপ পরামর্শ দেন অধ্যাপক ডা. আনোয়ার হোসেন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, সবচেয়ে ভালো আইসোলেট করে ফেলা। শনাক্ত করে আক্রান্তকে আলাদা করে ফেলতে হবে। এর জন্য পরীক্ষা বাড়াতে হবে। যত বেশি আইসোলেট করতে পারব, ততবেশি সংক্রমণ ঠেকাতে পারব।

এ ব্যাপারে অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, করোনার ইনফেকশন প্রিভেনশন কন্ট্রোলের ক্ষেত্রে এখন কভিড ও নন-কভিড হাসপাতাল ভাগ করা যাবে না। কে ডক্টর, কে ক্লিনার, সেটা দেখলে হবে না। সব রোগীকে কভিড রোগী বিবেচনায় নিয়ে তাদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য যা যা সুরক্ষা দরকার, সব দিতে হবে। চিকিৎসক-নার্স থেকে শুরু করে একজন ক্লিনার সবাইকে মানসম্মত পিপিই ও মাস্ক পরে চিকিৎসায় যেতে হবে।

করোনার জৈবিক পরিবর্তনের উদাহরণ টেনে জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালের শিশু কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ শাহরিয়ার বলেন, রোগটি ক্রিটিক্যাল হচ্ছে। কারণ ভাইরাস মিউটিশন হচ্ছে। বাংলাদেশে মিউটিশন হয়ে এমন রূপ নিয়েছে, দেখা যাচ্ছে ৩০-৪০ বছর বয়সী তরুণদের বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। বাইরে উল্টো। বয়স্ক লোকদের বেশি আক্রান্ত করছে।

একটা শিশু এসেছিল, ওর মধ্যে করোনা পজিটিভ পাই। ওর রক্তে প্লাটিলেট কমে গিয়েছিল। অনেক রোগী লাংসে ইনফেকশন হয়ে নিউমোনিয়ায় মারা যাচ্ছে। করোনার কিন্তু সাধারণ লাংসে অ্যাটাক হওয়ার কথা, গলায় ব্যথা হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে অনেক করোনা রোগীর ডায়রিয়া হচ্ছে।

‘এ মহামারীর সময় অবশ্যই কোনো রোগীকেই বিনা চিকিৎসায় বিদায় করা যাবে না। সবার চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল এবং চিকিৎসকদের সবাইকে একটা নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে আনতে হবে।

কারণ দেশে করোনার সংক্রমণ, উপসর্গ ও চিকিৎসা জটিল হচ্ছে। কারণ করোনা কমিউনিটিতে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছে। কে কোথায় থেকে কার মাধ্যমে সংক্রমিত হচ্ছেন, এটা এখন আর বোঝা যাচ্ছে না’ পরামর্শ দেন এ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।


যোগাযোগ

বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যলয়

কাব্যকস সুপার মার্কেট, ৩ ডি কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫।

মোবাইলঃ ০১৬২২৬৪৯৬১২, ০১৬০০০১৪০৪০

মেইলঃ tadantachitra93@gmail.com, tchitranews@gmail.com

সামাজিক যোগাযোগ

Web Design & Developed By
A

তদন্ত চিত্র কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েব সাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি।